সামাজিকতার গ্যাঁড়াকলে

গ্রামে এসেছি। নানীবাড়িতে। এখন কিছুদিন কিছু সহজ উষ্ণতা মন ছুঁয়ে যাবে। শহুরে কোলাহল থেকে মুক্ত, আমা্র খুব প্রিয় কিছু মানুষের নিরাপদ সান্নিধ্যে আর প্রশ্রয়ে থাকতে পারব কটা দিন।

কিন্ত, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে।  ঈদের সময় ঘুরতে এলে অনেক সামাজিকতার প্যাড়া আছে। এর বাড়ি যাও। ওর বাড়ি যাও। যদি না যাও, তুমি অসামাজিক, দেমাগী, অমুকের মেয়ের মাটিতে পা পড়ে না। কী যে ভাবে নিজেকে! আরো কত কী!

দাঁতে দাঁতে চেপে সে পর্ব যদি কোনরকমে সারাও যায়, তার পরই আসে মহা এপিসোড। বাড়িতে বেড়াতে আসা লতায় পাতায় সম্পর্কিত আত্মীয়-পরিজনের সাথে কুশল বিনিময় এপিসোড। ‌আমার মায়ের বিশাল পরিবার। আমার একটা জন্ম চলে গেল শুধু কে কী হয়, তাই মনে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করতে করতে। এর সাথে বোনাস হিসেবে আছে সমগ্র এলাকাবাসী। আমার নানার চেয়ারম্যানির সুবাদে গোটা তল্লাট কোন না কোনভাবে আমাদের আত্মীয়। কখন যে কে কোনদিক দিয়ে কোন প্রশ্ন করে বসবে তার কোন ঠিক নেই। শুরুটা হতে পারে এরকম:

“আমাকে চিনতে পারছ নাকি গো?”

অত্যন্ত রিস্কি প্রশ্ন। ছোটবেলায় শার্লক হোমসগিরি করতে গিয়ে বহুবার ধরা খেতে হয়েছে। ছোটবেলায়, আমার সায়েন্স অব ডিডাকশনগুলো এরকম ছিল-আমার মায়ের জেলার সম্বোধনগুলো হবে নানা-নানী মামা-মামী, অথবা খালা-খালু। অন্য সম্বোধনগুলো সব আমার বাবার জেলার। তো, সায়েন্স অব ডিডাকশনের ফর্মূলা মেনে আমি নিয়ে ফেলি আমার দ্বিতীয় অনুসিদ্ধান্ত। যেহেতু ভদ্রলোকের চুল অনেকটাই কাঁচাপাকা, এবং তিনি আমার মায়ের চেয়ে বয়সে বেশ খানিকটা বড়, অতএব তিনি আমার মামাই হবেন। আমি মুখে যথাসাধ্য ভদ্রতা ফুটিয়ে বলি-মামা! ঠিক তখনি দশদিক প্রকম্পিত করে সবাই সমস্বরে বলে উঠতেন- “পাগলী কী বলে? উনি তোমার ভাইয়া !” বোঝ ঠ্যালা! এই মধ্যবয়সী লোকটি কিনা এক দশ বছরের বালিকার ভাইয়া হয়! বহুবার ঠেকা খেয়ে ইদানীং সৎ থাকার নিরাপদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।এরকম প্রশ্নের উত্তরে তাই ঘাড়টা দ্বিধার সাথে দুই দিকে দুলিয়ে অস্ফুটে না বলি। একইসাথে মুখে ভদ্রগোছের একটা মহাদু:খপ্রকাশের ভঙ্গিও ফুটিয়ে রাখতে হয়। নইলে, আমার মাকে শুনতে হবে-তার মেয়ে কোন আদব জানে না।

অতিথি আমার মুখময় লেপ্টে থাকা ভদ্রতায় সন্তুষ্ট হয়েছেন কীনা বোঝার আগেই ধেয়ে আসে আরো প্রশ্নবাণ। কী করছ, কোথায় পড়ছ, পড়াশোনা কবে শেষ হল, ও তুমি তাহলে অমুকের সাথে একই ব্যাচ, তমুককে চেন কীনা? (যেন এক ব্যাচের বা জেলার হলেই সবাই সবাইকে চিনতে বাধ্য)  অমুকের ছেলে/মেয়ে তো খুবই ব্রিলিয়ান্ট। n সংখ্যক A+ বা ফার্স্ট ক্লাসে অলংকৃত। উনার পরিচিত সমস্ত ব্রিলিয়ান্টদের জীবনী মুখস্থ না করে কোন উপায় থাকে না তখন।

এরপরের অবশ্যাম্ভাবী প্রশ্নটা হল- কী করছ? আমার উত্তর শুনে তার দ্বিধাহীন মন্তব্য- “কিন্তু সরকারি চাকরি যে করতে হবে ভাইয়া। সরকারি চাকরির একটা আলাদা মর্যাদা। হ্যালোর দাম থাকতে হবে। এসব চাকরিতে বেতন যতই দিক, তোমার তো হ্যালোর দাম নাই। বিসিএসটা দিতেই হবে।”

আমি জানি, সরকারি চাকরির পক্ষে-বিপক্ষে কোনরকম তর্ক এনাদের সাথে করে লাভ নেই। এদের সামনে মার্ক জাকারবার্গকে এনে দাঁড় করিয়ে দিলে তাকেও এরা বিশ্বাস করিয়ে ছাড়বে যে, সে কোন সরকারী চাকরিতে জয়েন না করে নিজের জীবনটা নষ্ট করে ফেলল।

এর পরের প্রশ্নটা আরো মারাত্মক। সে প্রসঙ্গে না যাই। তবে, এই যুগে এসে আমাদের বোঝা উচিত, পৃখিবীর সব দেশে, সব ভাষায় ‘ব্যক্তিগত’ বলে একটা শব্দ আছে। বাংলা ভাষায়ও আছে । শব্দটা আমাদের পরিচিত। মানেটা কী জানা?

সবশেষে বলি, সামাজিকতা, তোমার ক্ষুরে সালাম!

 

 

3 comments

  1. আসলে আমি লেখাটা লিখেছি অভিমানের খেয়ালে। বিভিন্ন কারণে আমি এই সব মানুষের প্রতি ক্ষুব্ধ। তোমার ভালো নাও লাগতে পারে। কারণ আমি কারো মনোরঞ্জনের জন্য লেখাটা লিখি নি। কারণ লেখক যখন হাততালি প্রত্যাশা করেন তখন সাহিত্য স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়ে। কারও মনোরঞ্জন করলে যা হয়, একটি শিশু তো আর সবসময় একই খেলনা নিয়ে খেলে না। আজ কোনো খেলনা কিনে দিলে কাল তা ফেলে দেবে এটাই স্বাভাবিক। সাহিত্যও সেরকম। আজ যা প্রকাশিত হয়, কাল তা সমাদর হারাবে এটাই স্বাভাবিক।

    Like

  2. হুমম। আমি অবশ্য তোমার রিঅ্যাকশনটা পুরোপুরি মানতে পারছি না। সমাজের কিছু প্রথা ভুল, কিছু মানুষ ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত। তাই বলে তাদেরকে আমরা খারাপ বলতে পারি না। খারাপ বলা মানেই Judgemental হয়ে যাওয়া। সেটা হওয়া অন্য্যায়। আমার এই লেখাটা আমি তাদেরকে খারাপ দেখাতে লিখি নি। এটা একটা স্যাটায়ার ছিল।
    আর আমরা যারা মনে করি, আমাদের কাছে সঠিক তথ্য আছে, সত্যের সন্ধান আছে -তাদের উচিত ্ওই মানুষগুলোর প্রতি আরো সমবেদনাশীল হ্ওয়া।

    Liked by 1 person

  3. একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন সে পারিপার্শিকতা সম্পর্কে অন্ধকার মনে করে। কেননা শিশুটি জন্মান্ধ। কিন্তু যখন হাটতে শেখে, প্রিয় মানুষদের সাথে চলতে শেখে, তখনই সে নিবদ্ধ হয় কঠিন ও রূঢ় সামাজিকতার ঘেরাটোপে। কেই ইচ্ছা করে ধর্মবিদ্বেষী হয়না। সমাজই মানুষকে ধর্মবিদ্বেষী হতে বাধ্য করে। আবার সমাজই মানুষকে ধর্মবিদ্বেষী হবার দায়ে দণ্ডিত করে। সমাজ বাস্তবতা যখন শিশুটির সামনে ধরা দেয়, তখন সে হারাতে থাকে কল্পক্ষমতা। চোখে দেখতে থাকে আঁধার।
    বাংলাদেশে পল্লী অঞ্চলে মানুষগুলো এমনই। কেননা ওদের রয়েছে শিক্ষার অভাব। রয়েছে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের অভাব। সুতরাং ওরা অল্প বুঝবেই। যেমন আমি যখন মেহেরপুরে যাই, তখন আমার চারপাশে সবাই জেঁকে ধরে। এরা কেউ সম্পর্কে আমার খালা, মামা, খালু, মামী, চাচা, ফুফু, চাচী, ফুপা। কেউ কেউ বহিরাগত। আমি কী করে বুঝবো আমার চাচার বয়সী লোকটি আমার ভাই। কিংবা ভাইয়ের বয়সী ছেলে আমার মামা। ওরা কেউ মানতে চায় না। যেন পৃথিবীর সকলের বায়োডাটা আমাকে জেনে রাখতে হবে।
    আসলে এরা সম্পর্কের বিষয়ে এককাট্টা। সম্পর্ক সচেতন না হলে এদের বাণীবদ্ধ তলোয়ারের আঘাতে মাথা কাটা যাবে। আমার বোন আখি আপু আমাকে প্রায়ই সবার সাথে মেলামেশার তাগিদ দিত। আমি তার কথা শুনি নি। কারণ আমি কেন তার কথা শুনব? আমি কি অপরাধী ? সমাজের মানুষজনই খারাপ। কারণ নাকি জনশ্রুতি আছে মানুষ সামাজিক জীব।মানুষ কি করে জীব হয়। মানুষ জীবসত্ত্বা পরিবেষ্টিত বুদ্ধিবৃ্ত্তিক দ্বিপদ প্রাণী। জীবের দুটি সত্ত্বা আছে: প্রাণী ও উদ্ভিদ। তাহলে মানুষ হয প্রাণী ও উদ্ভিদ। এই স্ববিরোধী উক্তিকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সভ্যতা। আর যারা এগুলোর বিরোধীতা করে তাদের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করে চলতে হয়।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s