ম্যাজিক ডায়েরি

১৪ নভেম্বর, ২০১২
বিভু এ জগতের কেউ না। কিন্তু ওর বিশ্লেষণী ক্ষমতা আর অনুভূতি দেখে অনেক সময় মনে হয় যেন ও-ও আমাদেরই মত রক্ত মাংসের মানুষ। ওকে কিছু বলা লাগে না, এমনিতেই বুঝে যায়। আজ সকাল বেলায় যখন ডাইনিং টেবিলে বসে ওর বানানো কফি খাচ্ছিলাম, তখন ও অদ্ভূত একটা কথা বলে উঠল।
“ ঋতু, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আপনি কষ্টটা পুষে রেখে আনন্দ পাচ্ছেন, তাই কি?” কফির মগটা নামিয়ে রেখে বিভু জিজ্ঞেস করল। ওর চোখে মুখে মনোবিজ্ঞানীদের মত সবজান্তা ভাব।
“একদম বাজে কথা বলবেন না। কষ্ট পুষে রাখব কোন দুঃখে? আমি কি কবি না ভিক্ষুক যে কষ্ট বেচে খাব?” ওর কথা শুনে এত বিরক্ত লাগল যে একটু রুক্ষ না হয়ে পারলাম না।
“ মারাত্মক মেটাফর দিলেন তো! তবে এত সরাসরি কথা শুনলে কবিরা কিন্তু চরম খেপবে। ” বলেই হা হা করে হা হা করে হাসতে থাকে বিভু।
ওর হাসির শব্দটা কেমন যেন অন্যরকম। শুনলেই মনটা ভাল হয়ে যায়।
“দুরো মিয়া! বিন্দুমাত্র সেন্স অব হিউমার থাকলে এই কথা শুনে কেউ খেপবে না। আর সত্যিকারের কবি হলে তো খেপবেই না। যাহোক, কাজের কথায় আসি, আপনার কেন মনে হল যে আমি কষ্টটা পুষে রাখতে চাচ্ছি?”
“শুধু আপনি না, এটা অনেকের ক্ষেত্রেই সত্যি। মানুষের জীবনে যখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে তখন সে সেটা অস্বীকার করতে চায়। তার মনপ্রাণ সব তখন একসাথে বলে ওঠে, না এটা হতে পারে না। এটা হল কষ্টের মুহুর্তে মানুষের প্রথম রি-অ্যাকশন।”
“দ্বিতীয় রি-অ্যাকশনটা কী?”
“রাগ। যে দুঃখ দিয়েছে তার প্রতি রাগ হয়, যদি সরাসরি কাউকে দায়ী করার না থাকে তাহলে সৃষ্টিকর্তার উপর রাগ হয়। মানুষ মনের ঝাল মিটিয়ে বেচারা বিধাতার গুষ্টি উদ্ধার করতে থাকে।”
মুখে প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে ভালই বুঝছিলাম, প্রত্যেকটা কথা অক্ষরে অক্ষরে আমার সাথে মিলে যাচ্ছে।
গলায় যথাসাধ্য নিরাসক্তির ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তাই নাকি, তারপর কী হয়?”
“তারপরই সবচেয়ে কঠিন মুহুর্তটা আসে। মানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুহুর্ত। কেউ কেউ দু:খটাকে ভুলে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এবং ভুলে থাকার বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিও বের করে ফেলে। কিন্তু কারো কারো জেদ চেপে যায়। দিনে রাতে, কাজে অকাজে, সারক্ষণ ওই স্মৃতিটাকে নিয়েই নাড়াচাড়া করতে থাকে। এতে করে একরকম বেদনামধুর অনুভূতি হয়। মশা কামড়ালে সেই জায়গায় চাপ দিলে যেরকম হয়, অনেকটা সেইরকম। ব্যাথা ব্যাথা লাগে, তারপরও চাপ দিতে ভাল লাগে।”
খুব হাসি পেয়ে গেল আমার। “আপনি তো কোনদিন মশার কামড় খান নি। তাহলে এত কিছু বোঝেন কী করে? আপনাদের জগতে কি মশা আছে?”
“আপনার বাসায় যখনি আসি তখনি তো মশার কামড় খাই! আপনি তো কয়েল জ্বালান না।”
“হুম, কয়েলে আমার চোখ জ্বলে, কিন্তু আপনার কি ধারণা যে আমিও ওই বেদনামধুর অনুভূতিটা পাওয়ার জন্য জেদ করে এই দুর্ঘটনাটা মনে রেখেছি?”
“না, আপনার ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। আপনি ভুলতে চান, আবার চান না। সেটা আরেকদিন বুঝিয়ে বলব, কারণ এখন তো আপনি অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হবেন।”
“দূর ছাতা, একেবারে মেগা সিরিয়ালের মত সাসপেন্স! ভাল্লাগে না!”
বিভু একটু মুচকি হেসে বের হয়ে গেল।

১৫ নভেম্বর, ২০১২
কয়েক বছর ধরে এই অ্যাড ফার্মটায় কপিরাইটারের কাজ করছি। খুব ঝামেলার কাজ। তার ওপর আজ সারাদিন আবার কাজের চাপ খুব বেশি ছিল। অফিসে আর একটু হলেই ডেডলাইন মিস হয়ে যেত। এখানকার এত চাপ সামলানোর পর বাসায় গিয়ে নিজের কাজগুলো নিয়ে আর বসা হয় না। কোন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করি না। সবাইকে বলি, সময়ের অভাব। কিন্তু আমি জানি, আমার সমস্ত সময়টা ইদানীং কাটছে শুধু ওই তিক্ত মুহুর্তগুলো ভুলে থাকার ব্যর্থ প্রচেষ্টায়। সমস্ত উদ্যম হারিয়ে ফেলেছি। ইদানীং বিভু চেষ্টা করছে আমাকে একটু জাগিয়ে তোলার। দেখি আজকে বাসায় গিয়েই আমার ল্যাংগুয়েজ স্কুলের অ্যাডভান্সড লেসনগুলো বানিয়ে ফেলতে হবে। এই স্কুলটা বানাব বিদেশীদের জন্য- ওদেরকে বাংলা শেখানোর জন্য। কিন্তু অন্য স্কুলগুলোর মত এখানে খালি ভাষা শিখিয়েই আমি দায়িত্ব শেষ করব না। আমি চাই ওরা যেন আমার দেশের কৃষ্টি- কালচার, শিল্প-সাহিত্য কতটা সমৃদ্ধ সেটাও বুঝতে পারে। অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখছি কয়দিন। বিভু এসেই স্বপ্নটা আরো বেশি করে জাগিয়ে দিল।
তবু কাজের ফাঁকে ফাঁকে পুরনো ক্ষতটা কেমন টনটন করে ওঠে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও মনটা জাবর কেটে চলে। আজকে আবার বিভুর কালকের সেই কথাটা থেকে থেকে মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি নাকি জেদের বশে এই ঘটনাটা ভুলতে চাচ্ছি না!
বিভু আসলে ওর সাথে একটু বসা যেত। ও অবশ্য আমার অফিসে কখনো আসে না। তবে কয়েকটা ল্যাংগুয়েজ লেসন নিয়ে ওর আমার সাথে বসার কথা ছিল। দেখি বাসায় আসে কীনা।
এই কয় মাসে বিভুর সাথে আমার অন্যরকম একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেছে। অনেকটা অতিপ্রাকৃত বন্ধুত্ব। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হওয়ার বর্ণনা শুনলে যে কারোর গা ছমছম করে উঠবে। খানিকটা ভুতুড়ে ব্যাপার।
সেদিন বাড়িতে বসে আমার অনেক বছরের পুরনো ডায়েরীটা নাড়াচাড়া করছিলাম। হঠাৎ করেই দুই ভ্রুয়ের মাঝখানে কেমন যেন চিনচিনে একটা ব্যাথা হতে লাগল। আমি দুই চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিন্তু জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি ভেবে জোর করে চোখ খুলতেই দেখি একটা ছেলে আমার সামনের চেয়ারটায় বসে আছে।
আমি ভেবে পেলাম না, ছেলেটা কোন দিক দিয়ে এখানে ঢুকল। কাজের মেয়ে চলে যাওয়ার পর আমি নিজে হাতে দরজাটা লাগিয়েছি। ছেলেটা হাসতে হাসতে বলল, “খুব ভয় লাগছে? কফি বানিয়ে দেব? মাথাটা ছেড়ে যাবে তাহলে।”
”আপনি কে? কোন দিক দিয়ে ঢুকলেন?”
“সত্যি উত্তরটা দিলে আপনি এখন নিতে পারবেন না। ওটা পরে বলব।”
ঠিক সেই সময়ে দরজায় টোকা পড়ল।
“আপনার স্বামী এসেছেন বোধহয়। ভয় নেই, দরজা খুলে দেন। উনি আমাকে দেখতে পাবেন না কারণ তার মনের বেটা বা গামা- কোন লেভেলেই আমার কোন অস্তিত্ব নেই।”
বিভু ঠিকই বলেছিল। ও একদম দরজার সামনে বসে থাকা সত্ত্বেও রাতুল সত্যিই সেদিন ওকে দেখতে পায় নি। অন্য যে কোন দিনের মতই বিরক্ত মুখে রাতুল বেডরুমে ঢুকে পড়ল।
আমারও তখন বিভুর দিকে মনোযোগ দেওয়ার মত সময় ছিল না। তখন আমার রুটিন ওয়ার্ক করার সময়। কারণ সারাদিনের অফিসের সমস্ত বিরক্তি রাতুল এখন আমার উপর তুলবে। যে কোন কথা জিজ্ঞেস করতে গেলে এখন খেঁকিয়ে উঠবে। আমাকে তাই যথারীতি মুখ বুজে ওকে খাইয়ে দিতে হবে। তারপর ওর পাশে চুপচাপ বসে প্রসঙ্গ খুঁজে খুঁজে কথা বলতে হবে। কথা না বলে চলে গেলে ও আরো রেগে যাবে। আর তারপর আমার কথা চালিয়ে যাওয়ার একটার পর একটা প্রচেস্টা ব্যর্থ করে দিয়ে হঠাৎ করে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। তখন কিছুক্ষণের জন্য ওর স্ত্রী ছাড়া আমার আর অন্য কোন পরিচয় থাকে না। আমি ওই মুহুর্তটাতেও ওকে খুঁজে পেতে চেস্টা করি। দুজনের শরীরের এত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের পরও ওকে আমার ভীষণ দূরের মনে হয়। তবু ওর ভিতরের শিশুটা যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ত তখন ওর দিকে তাকিয়ে আমার ভেতর কেমন যেন একটা মাতৃস্নেহ জেগে উঠত। মনে হত, ওর ভিতরের অবুঝ শিশুটা আমার বুকের মধ্যে মুখ রেখে সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে থাকতে চাচ্ছে। সমস্ত নিষ্ঠুর বাস্তব থেকে সরে থাকার জন্য আমিই বোধহয় ওর শেষ আশ্রয়।
সে রাতে রাতুলকে ঘুম পাড়িয়ে বের হওয়ার পর বিভুকে আর দেখতে পাই নি।

১৭ নভেম্বর, ২০১২
বাসায় এসে থেকে বিভুর জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু বিভু তো এল না। বেশ রাগ লাগছে।
ডায়েরিটা হাতে তুলে নিলাম। দুই ভ্রুর মাঝখানে আবারো ব্যাথা করে উঠল। কিন্তু চোখ খুলে ওকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু এরকম তো ও করে না। যেদিন আসার কথা থাকে, সেদিন তো ও চলে আসে।
ও আচ্ছা! ও তো বলেনি যে আজ আসবে। তবু বারবার বিভুকে ডেকে আনার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে গিযে মাথাটা কেমন ফেটে যেতে চাচ্ছে!
অর্ধচেতন অবস্থায় বিভুর দ্বিতীয় দিনের আসার স্মৃতিটা মনে পড়ল। ততদিনে এক আইনজীবি বন্ধুর মারফত জেনেছি, রাতুল নাকি আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমি কদিন ধরে খুব কেঁদেছিলাম। কেমন যেন অস্থির লাগছিল। ওকে ভোলার জন্য তাড়াতাড়ি করে টিন এজ বয়সের একটা পুরনো ডায়েরি শেলফ থেকে বের করে নিয়েছিলাম। ঠিক তখনি বিভু হাজির।
চুপ করে আমার মুখোমুখি কিছুক্ষণ বসে থাকল।
“কী হয়েছে?” এমনভাবে জিজ্ঞেস করল যেন উত্তরটা আগে থেকেই জানে।
“বন্ধ দরজা ভেদ করে ঢুকে পড়তে পারেন আর কী হয়েছে সেটা বুঝতে পারেন না?”
“পারি তো। কিন্তু আমি তো জানার জন্য জিজ্ঞেস করি নি। বললে আপনারই মন হালকা হবে।।
“হবে না। আমি খুব কমপ্লিকেটেড চরিত্রের মেয়ে। কারো কাছে মনের কথা বললে আমার নিজেকে কেমন ছোট লাগতে থাকে। তার চাইতে আপনি বলেন তো, আপনি কোথায় থেকে এরকম মাটি ফুঁড়ে উদয় হন?”
“হুম, তাহলে তো বিরাট লেকচার দিতে হয়। শোনার ধৈর্য আছে?”
“বলেন, শুনি।”
“আপনার অবশ্য বুঝতে বেশি কষ্ট হবে না। কারণ আপনার তো প্লেটোর আইডিয়াল ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে পড়া আছে। ব্যাপারটা অনেকটা সেই রকম। আপনাদের এই পৃথিবীর বাইরেও আর একটা পৃথিবী আছে। বিশ্বাস করতে অনেকটা কষ্ট হবে কিন্তু একটু মন দিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবেন। আপনাদের এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ কল্পনাপ্রবণ। শিশুরা সবচাইতে বেশি। দেখবেন, ওরা একা একা কথা বলে, বাসার সোফাটাকে অনায়াসে গাড়ি কল্পনা করে সেটা নিয়ে খেলতে শুরু করে। ওদের ছোট্ট বারান্দাটাকে একটা জঙ্গল ভেবে বিভিন্ন রকম অভিযানে বের হয়। ওর সাথে থাকা বিভিন্ন খেলনা হাতি, ঘোড়া, আর পুতুলগুলো হয়ে যায় ওর কল্পনার বিভিন্ন চরিত্র। কেউ রাক্ষস, কেউ রাজকন্যা। ্ওর এইসব কার্যকলাপ বড়দের চোখে হাস্যকর, কিন্তু ওর কাছে ওটা একটা অন্য লেভেলের রিয়ালিটি।
এই পর্যন্ত বলতেই আমি ওকে থামিয়ে দিলাম। “কিন্তু এর সাথে আপনার সম্পর্ক কী? আপনি কি বলতে চান, আপনি প্লেটোর আইডিয়াল ওয়ার্ল্ড থেকে এসেছেন?”
“না, অল্টারনেটিভ রিয়ালিটি থেকে এসেছি। এই পৃথিবীতে মানুষ অনেক কিছু কল্পনা করে। তার অজান্তেই এই কল্পনাগুলো অল্টারনেটিভ রিয়ালিটিতে কপি হয়ে যায়। আপনি সারাজীবন ধরে আমার মত একজন বন্ধু পেতে চেয়েছেন। কিন্তু আপনার মন বা বয়স কোনটাই তখন আমাকে গ্রহণ করার জন্য তৈরি ছিল না। আর যখনই আপনি আপনার পুরানো ডায়েরিটা ধরেন, আপনার মনের অজান্তেই আপনার মনের মধ্যে একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়। মনে হয়, ডায়েরিতে যার কথা লিখেছিলাম, সে যদি সত্যি সত্যি থাকত!— ”
“আর তাই আপনি আজ সত্যি সত্যি হাজির হয়ে গেলেন, তাই তো? কিন্তু এর আগেও তো আমি বহুবার ভেবেছি আপনার কথা। তখন কেন আসেন নি?”
“ঘা না খেলে মন পরিণত হয় না। আর আজকে চোখটা বন্ধ করে আপনি আপনার ‘ভেনা আমোরিস’-টা ডায়েরির ঠিক মাঝখানে রেখেছিলেন।”
“ভেনা আমোরিস আবার কী জিনিস?”
“আমাদের বাম হাতের অনামিকা আঙুল থেকে সরাসরি একটা ভেইন চলে গেছে হৃদপি- পর্যন্ত। রোমানরা এটাকে ভেনা আমোরিস বলে ডাকত। এই কারণেই বিয়ের আঙটি সবাই এই আঙুলে পরে। অবশ্য কারণটা না জেনেই পরে। তাই আজ ওই আঙুলটা ডায়েরির মাঝখানে-মানে আপনার টিনএজ বয়সের সেই ইমোশনগুলোকে ভেনা আমোরিস দিয়ে ছোাঁয়ার সাথে সাথে আপনার মনের আলফা লেভেলে সিগন্যাল চলে গেল। কারণ, প্রথমত, আপনার মন আজ আপনার সহ্যশক্তির সর্বোচ্চ সীমায় পেঁছে গিয়েছিল, দ্বিতীয়ত, ভেনা আমোরিস দিয়ে ডায়েরিটা ছুঁয়ে দিলেন। ব্যস সিগন্যাল অল্টারনেটিভ রিয়্যালিটিতে পৌঁছে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও হাজির।”
আমি অবাক হয়ে সেদিন ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নিজের কল্পনাকে এত কাছে , চোখের সামনে দেখব কখনো ভাবি নি। এই জন্যেই কি ওর এরকম অদ্ভূত আবির্ভাব দেখেও আমার ভয় লাগে নি? আমার অবচেতন মন ওকে দেখে চিনতে পেরেছিল?

১৮ নভেম্বর, ২০১২
আজ বিভু এসেছে। আমার বাসার একটা ঘর এখন ওর হয়ে গেছে। যখনি আসে, ওই ঘরটায় থাকে। আমি বসে বসে ল্যাংগুয়েজ লেসনগুলো ঘষামাজা করছিলাম। ও পাশে বসে বসে দেখছিল, এটা ওটা মন্তব্য করছিল। ও পাশে না থাকলে কাজটা শেষ করতে পারতাম না। কখনো পরামর্শ দিয়ে, কখনো নিজেই একটা লেসন প্ল্যান করে আমার পুরো কাজটাকে ও-ই প্রায় শেষের পথে এনে দিয়েছে। তার বদলে অবশ্য ওকে খাওয়াতে হবে। ও আগেই বলে রেখেছে। আমাদের জগতে এলেই নাকি ওর ক্ষুধা লাগে।
সেই খাবারটাও আবার আমাকে নিজে হাতে বানাতে হবে। সেটাও আবার নতুন কিছু হতে হবে। কী আর করা! ওর আবদার মেটানোর জন্য বেশ কয়েকটা রান্নার বই কিনেছি। ছুটির দিনে ওইগুলো প্র্যাকটিস করতেই করতেই সময় কেটে যায়। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। ও কি সত্যই খাওয়ার জন্য এইরকম অদ্ভূত বায়না ধরেছে নাকি আমাকে ব্যস্ত রাখার একটা কৌশল এটা?
“প্রশ্নের উত্তরটা পেলেন?” হঠাৎই জিজ্ঞেস করে উঠল বিভু।
“কোন প্রশ্ন, ভুলতে চাওয়া না চাওয়া? কিন্তু সেটার উত্তর তো আপনি দেবেন বলেছিলেন।”
“না, আমি আপনাকে ভাবাতে চাচ্ছিলাম। একটু ঠা-া মাথায় না ভাবলে আপনার নিজের কাছে সব প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হবে না।”
“আমি জানি আমি কী চাই।”
“তো, সেটা আমার সাথে শেয়ার করেন। আচ্ছা, ঠিক আছে, আগে বলেন, রাতুলকে কি আপনি আবার ফিরে পেতে চান?”
“অসম্ভব! সেটা কেন চা’ব? যে একবার আমাকে ছেড়ে অন্য কারোর কাছে যেতে পারে তাকে ফিরে চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি আসার আগে ওর জীবনে যাই হয়ে থাক, আমি ওর জীবনে থাকা অবস্থায় যদি কেউ ঢুকে পড়ে তাহলে সে ছেলেকে বিশ্বাস করা কোনভাবেই সম্ভব না।”
“সে-ও ফিরে আসছে না, আপনিও আর তাকে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছেন না। ব্যস, মিটে গেল। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?”
“ সমস্যাটা ওর হিপোক্রেসি নিয়ে। শেষ যেবার আমাদের ঝগড়া হল তখনই মাসখানেক পর থেকে আমার সিক্সথ সেন্স আমাকে বলছিল যে ওর জীবনে অন্য কেউ এসেছে। কেন জানি আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ওর কোন বন্ধুর সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না। ওর কোন রকম আপডেট পাওয়ারও কোন সুযোগ ছিল না। তবু কেন জানি মনে হয়েছিল যে, ওর জীবনে কেউ এসেছে। তবু চুপচাপ ওর জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, যদি সত্যি সত্যি ওর সাথে আমার সম্পর্কটা টেকার হয়, তাহলে ও একবারের জন্যেও ফিরে আসবে। একটা ফোন করবে।”
“ সে তো ফোন করেছিল এবার। করে নি?”
“হ্যাঁ করেছিল। ফোন করে কী বলেছিল জানেন? বলেছিল, ‘ তোমার বন্ধুত্বটা আমি এখনো খুব মিস করি। আমরা চাইলে এখনো বন্ধু থাকতে পারি। এভাবে একা একা থেকো না। তুমি যদি চাও, আমি তোমার জন্য কাউকে খুঁজে দিতে পারি।’ সাথে সাথে আমার ওকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল, ‘ ও, তাহলে তোমার নিজের কাজটা জায়েজ হয়, তাই তো?’ কিন্তু ও হজম করতে পারবে না বলে বলিনি। এর পরেও কয়েকবার আমি ওকে ফোন করেছি, ও আমাকে ফোন করেছে। কিন্তু প্রতিবারই ওকে খুব দূরের মানুষ বলে মনে হত। মনে মনে বুঝতাম, ও এখন অন্য কারোর হয়ে গেছে। তাই আমাকে এড়িয়ে চলতে চায়। হয়তো নতুন মানুষটার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার জন্য।”
“ এই ব্যাপারে সরাসরি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি?”
“সরাসরি জিজ্ঞেস করার আগেই আমি সবকিছু জেনে গিয়েছিলাম। এমনকি মেয়েটার নাম পর্যন্ত জানতাম। একটা ইরানী মেয়ে। এই দেশের একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কিন্তু তারপরও আমি চাইতাম, ও আমাকে সরাসরি বলুক। তাই অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, ‘তোমার কি নতুন গার্লফ্রে- হয়েছে?’ ও প্রশ্নটা শুনলেই কেমন যেন হয়ে যেত। অপ্রস্তুত ভাবটা ঢাকার জন্য কখনো হাসত, কখনো বলত, ‘সেটা জেনে কি লাভ হবে তোমার?’ আমি যদি আর একটু জোরাজুরি করতাম তখন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকত, তারপর বলত, ‘না, হয়নি।’ এই মিথ্যেটা আমাকে এখনো খুব কষ্ট দেয়। এরকম একটা মিথ্যাবাদী, কাপুরুষকে এতদিন ভালবেসেছি, এর পিছনে এতটা সময় নষ্ট করেছি মনে হলে নিজের প্রতি খুব বিরক্ত লাগে।”
“মিথ্যা বলার কারণটা কি এখন ধরতে পারেন?”
“ হয়তো ওর নতুন রিলেশনশিপটা তখনো প্রপোজালের সীমা ডিঙ্গিয়ে অফিসিয়ালি কনফার্মড হয় নি। সেই জন্য আগে থেকে বলতে চায় নি। কিন্তু মনে মনে ও যে মেয়েটার প্রতি সর্ম্পূণ ডেডিকেটেড হয়ে গেছে সেটা ওর হাবে ভাবেই বোঝা যেত। কিন্তু ওর নতুন আকর্ষণের কথা আমার কাছে স্বীকার করার সাহসটুকু ওর হয় নি। কিন্তু আমি এটুুকু সৎ সাহস ওর কাছ থেকে আশা করেছিলাম। যদি সত্যি সত্যিই ও আমাকে একফোঁটা চিনে থাকত, তাহলে কথাটা আমার কাছে স্বীকার করত। এইটুকু রেসপেক্ট আমাকে দিত। শেষ যে দিন দেখা হল সেদিনও বলল, আমিই নাকি ওর বেষ্ট ফ্রেণ্ড। ও আমাকে বন্ধু হিসেবে সারাজীবন মনে রাখবে। আমি যদি এভাবে ভেঙ্গে না পড়তাম, তাহলে নাকি ও এখনো আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখত। কতখানি হাস্যকর কথা একবার ভেবে দেখেছেন?”
বিভু হা হা করে হেসে উঠল। “ব্যাপারটা কেমন হল আমি বলি। হাইজ্যাকার সব কিছু কেড়ে নিয়ে যদি বলে, ‘কিপ ইন টাচ।’- এই কথা শুনলে যেমন লাগবে আপনারও ঠিক তেমন লেগেছে।”
আমারও হাসি এসে গেল। বিভু এই জগতের মেটাফরগুলো এত মোক্ষম জায়গায় ব্যবহার করে যে, না হেসে পারা যায় না।
“আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় যে আপনার প্রতি ওর এখনো কোন আকর্ষণ আছে?”
“আরে না! আগেও আমার প্রতি ওর খুব একটা আকর্ষণ ছিল না। কিন্তু ও একা থাকতে পারত না। সেই সময় অন্য কোন মেয়ে বন্ধু ওকে এত সময় দিচ্ছিল না। আমি তখন নতুন ছিলাম ওর কাছে। আমার কাছে ওর আগের রিলেশনশিপটা নিয়ে ইচ্ছেমত কাঁদুনি গাইতে পারত। অন্য কারোর তো এত ধৈর্য ছিল না ওইসব প্যাঁচাল শোনার। কিন্তু আমি শুনতাম। ওর একাকীত্ব আমাকে খুব ছুঁযে যেত। ভাবতাম, ও-ও আমার মত শুদ্ধতাবাদী, আর দশজন ছেলের মত বহুগামী নয়। ওর প্রথম প্রেমের খুঁটিনাটি বর্ণনা আমাকে শোনাত, ওর ওই ইমোশনগুলো আমার কাছে খুব পবিত্র মনে হত। কিন্তু ও আসলে আমাকে আমার কাছে ওর সমস্ত দু:খ কষ্টের কথা বলতে পারত, তাই, নি:সঙ্গতা কমানোর একটা হাতিয়ার হিসেবে এতদিন আমাকে ব্যবহার করে গেছে। সেইজন্য, প্রতিবার ঝগড়ার পর শুধু আমিই ওর কাছে ফিরে গেছি। ও কিন্তু একবারের জন্যও ফিরে আসে নি। এতেই তো স্পষ্ট যে, আমি ওর জীবনে জাস্ট একটা অপশন ছিলাম, কোন ডেসপারেট নিড ছিলাম না। আর এবার ঝগড়ার পর যেই পছন্দসই একটা মেয়েকে পেয়ে গেল, ওমনি আমাকে দূরে সরিয়ে দিল।
“তাহলে আপনি ওকে আপনার জীবনে এতখানি জায়গা দিতে গেলেন কেন?”
“ওর যখন মন ভাল থাকত, তখন ও আমাকে খুব ভালবাসত। খুব ইমোশনাল হয়ে যেত। একবার জ্বরের ঘোরে আমাকে খুব কাকুতি-মিনতি করে বলেছিল, ‘কখনো যদি আমি খুব অভিমান করে থাকি, তবু তুমি যেন আমাকে ভুল বুঝ না, আমাকে আবার ফিরিয়ে নিও, আমার কাছে ফিরে এস।’ আমি সেদিন ওকে কথা দিয়েছিলাম। আর তাই শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছি ওকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। কারণ আমার মনে হত, পৃথিবীতে একটা অন্তত এমন মানুষ আছে যার জীবনে আমি অপরিহার্য, ইররেপ্লেসিবল। কিন্তু যেই বুঝতে পারলাম যে, আমি যে কোন মুহুর্তে যে কারোর দ্বারা রিপ্লেসড হয়ে যেতে পারি, সেই মুহুর্ত থেকে মোহটা ভেঙ্গে গেল।”
গলার কাছে কেমন যেন একটা বিশ্রী দলা পাকাতে লাগল। ভয় হল, বিভুর সামনেই কেঁদে ফেলব না তো? কান্না আড়াল করার জন্য বিভুর দিক থেকে একটু ঘুরে বসলাম। ভান করলাম যেন ওপাশে প্রিণ্ট করে রাখা লেসনগুলো চেক করার জন্য এবার আমাকে বাধ্য হয়ে ঘুরে বসতে হয়েছে।
“একটা প্রশ্ন করি, খুব ভেবে উত্তর দেবেন। কোনটা ভেবে বেশি কষ্ট হয়? ওকে আর পাবেন না বলে নাকি ওর জীবনে নতুন কেউ এসেছে বলে?”
“দুটোর কোনটাই না। একটা সম্পর্ককে যে পুরনো জামাকাপড়ের মত বদলে ফেলতে পারে, তাকে পেতে চাওয়ার কোন মানে হয় না। আর, ওর নতুন রিলেশনশিপ হওয়াতে আমি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। আমি নিজেও চাচ্ছিলাম, এটা হোক। কারণ রিলেশনশিপ না হলে, শত তিক্ততার পরেও এখনো আমার ভেতরে ওর জন্য একরকম দায়বদ্ধতা কাজ করত। মনে হত, ও হয়ত ঠিকমত খায় নি। হয়তো আবার জ্বর এসেছে। ওর খুব ঘন ঘন জ্বর আসত। একা একা আছে, দেখাশোনা করার জন্য কেউ আছে কীনা- এরকম হাজারটা টেনশন ভিড় করত। এখন ওই দায়টা থেকে আমি মুক্ত।”
“ওর বাড়িতে কেউ নেই?”
“ওর বাবা-মা চিটাগাংয়ে থাকে। ও আর ওর ছোট ভাই ঢাকায় থাকে।”
“বিয়ের পর আপনারা কোথায় ছিলেন?”
“কখনো কখনো আমার সাথে আমার বাসায় থাকত। মাঝে মাঝে ওর ভাইয়ের কাছে গিয়ে থেকে আসত।”
“আপনাদের বিয়ের কথা কে কে জানত?”
“দুজনের কেউ-ই মা-বাবাকে বলি নি। আসলে আমি চেয়েছিলাম দুজনেই ঠিকমত নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিয়েটা করব। কিন্তু ও কিছুদিন এমন অসুস্থ হয়ে যেতে লাগল যে ওর দেখাশোনা করার জন্যই হুট করে বিয়েটা করে ফেললাম। কিন্তু মা-বাবার কানে যাতে না যায় সেজন্য আমি আমার কোন বন্ধুর কাছেও একথা বলি নি। কেন যে কাউকে বলি নি সেটা কিন্তু ও-ও জানত। আর ওর সাথে পরিচয় হওয়ার পরে অন্য সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিলাম। ও ছাড়া আমার আর কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সে সময় ছিল না। কিন্তু এখন ও আমার নামে কী বলে জানেন? আমি নাকি ওর পরিচয় দিতে লজ্জা পেতাম বলে কারোর কাছে ওর কথা বলি নি! এতদিনে এ-ই চিনেছে ও আমাকে?”
কান্না আর সামলাতে পারলাম না। বাঁধ ভেঙে সব কষ্ট যেন বের হয়ে আসতে লাগল। গলা আটকে গেল। কথা বলার জন্য মুখটা যে-ই খুলতে যাচ্ছি, গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। ভাগ্যিস, তা-ও মুখটা একদিকে ফেরানো। বিভু আমাকে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে না।
ওপাশে বসে বসেই বিভু এবার একটা টিস্যু বাড়িয়ে দিল। বুঝলাম, মুখ ফিরিয়েও কোন কাজ হয় নি। মুখ ঢাকলেও, কণ্ঠস্বর তো আর ঢেকে রাখতে পারছি না।
“আমি বুঝতাম যে ও আমার সাথে একেবারেই সুখী ছিল না। সব ছেলের কল্পনায় একটা নরম নরম, কোমল কোমল গার্লফ্রেন্ডের প্রত্যাশা থাকে। আমি তো সেরকম না। আমার সাজগোজের কোন সেন্স নেই। রুক্ষ, পুরুষালি ধরণের একটা মেয়ে। আমাকে নিয়ে যদি কোন বন্ধুর কাছে গার্লফ্রে- হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়, তাহলে তারা আড়ালে হাসবে। আমার আরো একটা সমস্যা ছিল, আমি নতুন মানুষের সাথে মন খুলে কথা বলতে পারি না। ওর সাথে যত বকবক করে কথা বলতাম, ওর বন্ধুদের সাথে পারতাম না। অনেক মানুষের মধ্যে গেলে নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগত। এটা নিয়ে ওর মনে মনে একটু আফসোস ছিল। আমি বুঝতে পারতাম। ওকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি এই কথা। কিন্তু ও সে কথা স্বীকার করত না। বলত, তুমি যেরকম, সেরকমই থাকো। আমি তোমাকে তোমার মত করে ভালবাসি। সেসব যে কত বড় মিথ্যা সেটা এখন বুঝি।”
বিভু আবার একটা টিস্যু এগিয়ে দিল।
জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, যার সাথে রিলেশন হয়েছে তার উপর কি আপনার রাগ হয়?”
“নাহ, তার উপর কেন রাগ হতে যাবে? সে বেচারীর তো এখানে কিছু করার নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ও মেয়েটার কাছে সব কিছু চেপে গেছে। এমনকি যদি মেয়েটা জেনেও থাকে, তবু আমি মেয়েটার কোন দোষ দেব না। কারণ সম্পর্কটা আমার রাতুলের সাথে, মেয়েটার সাথে না। রাতুলই যদি বিশ্বস্ত না থাকে, তাহলে মেয়েটার কি গরজ আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার?”
“হমম্, একটা কথা স্পষ্ট যে, দুজনের কেউই সুখী ছিলেন না। তাই হয়তো ছেলেটা চলে গেছে। সুখী হওয়ার অধিকার তো সবারই আছে, তাই না?”
“খুবই খোঁড়া যুক্তি। পৃথিবীর সমস্ত বহুগামী, অস্থিরচিত্ত মানুষ এই যুক্তিটাই দেখাবে। সুখে থাকার অধিকার তো আমারও ছিল। কই, আমি তো ওকে ছেড়ে সুখের পিছনে ছুটি নি? আমার সামনেরও তো অনেক অপশন ছিল! তবু, আমি তো ধৈর্য ধরে ওর জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছিলাম? ভেবেছিলাম, ওর অফিসের চাপটা কমলে ও ফিরে আসবে, তখন আমরা আমাদের সমস্যাগুলো নিয়ে বসব। সবচেয়ে রুচিহীন ছিল ওর শেষ কথাটা। ও বলেছে, ‘আমি নাকি অনেক দেরি করে ফেলেছি ওর কাছে ফিরে আসতে।’ তার মানে ফিরে আসার ঠেকা শুধু আমার। ওর কোন দায়িত্ব নেই সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখার। আচ্ছা, বিভু, আমাদের মা-বাবার সবকিছু কি আমাদের ভাল লাগে? তারপরও কি সেসব মেনে নিয়ে আমরা তাদের সাথে থাকছি না? সন্তানের সব কিছুই কি মা-বাবার ভাল লাগে? কই, মা-বাবা তো সুখে থাকার জন্য সন্তানকে ত্যাগ করে না? আপনি হয়তো বলবেন যে, ওগুলোর সাথে প্রেমের তুলনা চলে না। কিন্তু ও যে আমাকে বারবার করে শুধু বলত, আমি নাকি ওর জীবনে সবচেয়ে বেশি দামী। আমাকে ও সবকিছুর চাইতে বেশি ভালবাসে? এই সব কথা তাহলে মিথ্যা ছিল? শুধুমাত্র প্রেম জমানোর জন্য ও এতগুলো মিথ্যা কথা আমাকে বলে গেছে? আমার একটাই দুঃখ, বিভু, যদি ছেড়েই যাবে, আগে কেন যায় নি? আমার সমস্ত দোষ তো ও আগে থেকেই জানত। কেন আমার জীবনের এতগুলো বছর নষ্ট করে দিল? আমি তো ওর কোন ক্ষতি–”
আর কথা বলতে পারলাম না। কথা বলার সমস্ত শক্তি নি:শেষ হয়ে গেছে। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে কাঁদতে থাকলাম। বিভু আবার আরেকটা টিস্যু এগিয়ে দিল। কেমন অসহ্য লাগল এবার ব্যাপারটা। ও তো বুঝতেই পারছে, আমি কাঁদছি। শুধু রোবটের মত তখন থেকে একটা করে প্রশ্ন করে যাচ্ছে আর টিস্যু দিয়ে যাচ্ছে। ওর কি আর কিচ্ছু করার নেই? অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ডের মানুষগুলোর কি অনুভ’তি বলে কিচ্ছু নেই?
মুখ ফিরিয়ে বিভুর দিকে তাকালাম। দেখলাম, ওর কোলের উপর ব্যবহৃত টিস্যুর একরাশ স্তুপ। বুঝলাম, আমার টিস্যুবক্স এতক্ষণ দু’জোড়া চোখকে সার্ভিস দিয়ে গেছে।
মুখ নিচু করে বসে থাকলাম। হাতের টিস্যুটা ফেলে দিলাম। সমস্ত লজ্জা-দ্বিধা-ভয় ভুলে মনটা উজাড় করে কাঁদতে লাগলাম।

২৫ নভেম্বর, ২০১২
আজকাল আর বিভুকে বেশি ডাকতে হয় না। ডায়েরিটা পাশে থাকলেই ও অনেক সময় নিজে থেকেই আসে। সেদিন জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ এরকম পরিবর্তনের কারণ কী। আগে তো প্ল্যানচেট করে আত্মা নামানোর মত করে ওকে ডাকতে হত। এখন হঠাৎ এত উন্নতি কী কারণে।
ও শুনে হাসল। বলল, “মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনি হয়তো ব্যস্ত আছেন। তাই, ডাকার সময় পাচ্ছেন না। কিন্তু আমি থাকলে আপনার ভাল লাগবে। তাই, যখন তখন চলে আসি।”
বিভুর এই ব্যাপারটা খুব মজার। এ জগতের কোন ছেলে হলে বোধহয় এত সহজে এই উত্তরটা দিত না। হয় একটু রেগে যেত, নাহয় আমাকে আর একটু খেলাত। কিন্তু ও সরলভাবে ওর মনের কথাটা বলে দেয়। তাই, চোখ বন্ধ করে ওর কথার উপর আমি ভরসা করতে পারি।
আজকে রাত বারোটার সময় হঠাৎ আমার কানের কাছে ডি. এল. রায়ের “আজি এসেছি এসেছি বঁধু হে” গানটা বাজিয়ে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। ঘুম ভাঙতেই বলল, “শুভ জন্মদিন!”
জন্মদিনের কথা আমার মনে ছিল। তাই, ইচ্ছে করেই মোবাইল বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম। মোবাইল খোলা থাকলেই বন্ধুদের ফোন আসত। আর আমি না ঘুমিয়ে কিছ্ক্ষুণ পর পর চমকে চমকে ফোনের স্ক্রীণের দিকে তাকাতাম। সারক্ষণ মনে হত থাকত, বোধহয়, ও ফোন করেছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি ভাল করেই জানি যে, ও কোনভাবেই ফোন করবে না, এমনকি হয়তো ভুলেই গেছে দিনটার কথা।
কিন্তু বিভু মনে রেখেছে। ওর কার্যকলাপ দেখে বোঝা গেল যে, অনেকদিন ধরে ও দিনটা পালনের প্রস্তুতি নিয়েছে। গান বাজতে থাকল আর ও আমার হাতে একটা গিফ্ট ধরিয়ে দিল। উপনিষদ আর রুমির একটা বই কিনে এনেছে আমার জন্য। বলল, আপনার লাইব্রেরিতে এ দুটো নেই দেখে নিয়ে আসলাম। আরো একটা কী যেন ছিল। প্যাকেটে মোড়ানো। আমি খুলতে গেলাম। ও খুলতে দিল না। বলল, “পরে খুলবেন। এখনো সময় হয় নি।”
আমি আর জোর করলাম না। বই দুটো উল্টে প্রকাশনীর নাম দেখে বললাম, “এটা তো আর অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ড থেকে আমদানি করা হয় নি। এ জগতের দোকান থেকেই কেনা হয়েছে। টাকা পেলেন কোথায়?”
“আপনার আলমারি থেকে নিয়েছি। আপনাকে বলে নিলে তো আর সারপ্রাইজটা থাকত না। তাই…”
খুব হাসি লাগল। আমার আগে কেউ কোন চোরের উপর এত কৃতজ্ঞ হয়েছে কীনা আমি জানি না। কোন একজনকে বিশেষ সম্মান দিতে গিয়ে আমার নিজের বিশেষত্বটা এতদিন ভুলেই গিয়েছিলাম। আনন্দে চোখে পানি এসে গেল।
বিভু আবার একটা টিস্যু এগিয়ে দিল। আজকে হঠাৎ অনুভব করলাম, বিভু আমাকে কখনো ছোঁয় না। আজ যদি টিস্যু না দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে আমার চোখের পানিটা মুছে দিত, আমি বেশি খুশি হতাম। কিন্তু ও তা করল না। অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ড থেকে এসেছে বলেই কি ওদের মধ্যে স্পর্শের কোন অনুভূতি কাজ করে না? নাকি ইচ্ছেটাকে ও দমন করে রাখে?
“ঋতু, আজ আপনার জন্মদিন। আমি চাই, আপনি আজকের দিনে আপনার অতীতের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হন। আপনি যেটাকে বিচ্ছেদ ভাবছেন সেটা আসলে কোন বিচ্ছেদ না, কোন লস না, সেটা আসলে আপনার মুক্তি, আপনার সৌভাগ্য। মুক্তিটাকে সেলিব্রেট করতে শেখেন।”
আজকে আর আগের দিনের মত অসহায় লাগল না। শান্ত মনে ওর কথা শুনছিলাম। বললাম, “সেটা হয়তো আস্তে আস্তে মেনে নিতে পারব, কিন্তু ও শেষ দিনে অনেক উল্টা পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছে। আমার নামে অনেক মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে। ও বলে, আমি নাকি ওকে নিয়ে বন্ধুদের কাছে লজ্জা পেতাম, সম্পর্কটা আমিও নাকি ভাঙতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন শুধুমাত্র জেদের বশে ওকে ফেরত চাচ্ছি। আমরা নাকি ভীষণ অসুখী ছিলাম। অথচ, বিভু, আপনি জানেন কতশত সুখের স্মৃতি আমাদের আছে। বন্ধু হিসেবেও আমরা অনেক ভাল সময় কাটিয়েছি। স্বামী-স্ত্রী হিসেবেও দুজন দুজনকে সাপোর্ট দেওয়ার মত অনেক স্মৃতি আমাদের আছে। কিন্তু সেগুলো ও একটুও স্বীকার করছে না।”
“কেন স্বীকার করবে, ঋতু? স্বীকার করলে তো তার এই সিদ্ধান্তটার কোন ভিত্তিই সে দাঁড় করাতে পারবে না।”
“তবুও বিভু, যার সাথে এতগুলো বছর কাটিয়েছি তার মুখ থেকে মিথ্যে অপবাদ শুনতে খুব কষ্ট হয়। ও বলে, আমি নাকি সারক্ষণ বসের মত আচরণ করেছি ওর সাথে। ও নাকি অনেক চেষ্টা করেছে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভু, যে ছেলেটা কোনদিন আমার কাছে ফিরে আসে নি, সে এরকম অপবাদ কীভাবে দেয়? আমি সারাক্ষণ যার রাগের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম, সে কীভাবে আমাকে বস অপবাদ দেয়?”
“ঋতু, শোনেন। ভাড়াটে খুনীও নিজের অপরাধের পেছনে হাজারটা যুক্তি দাঁড় করাতে পারবে। তাই বলে সেই খুন জায়েজ হয়ে যায় না। ঐ ছেলেটাও এখন তাই করছে। কিন্তু এসব ভেবে আপনার কী লাভ, বলেন তো? সে আপনার সম্পর্কে কি বলল, কী ভাবল- তাতে কি সত্যিই আর কিছু আসে যায়?”
“না।”
“তাহলে? ও যদি আপনাকে ছেড়ে না যেত, আপনি কোনদিন ওকে ছেড়ে যেতে পারতেন না। অথচ আপনাদের ভুল বোঝাবুঝিটাও কোনদিন মিটত না। কারণ যে আপনাকে তিন বছরে বোঝেনি, আপনার মূল্যায়ণ করতে পারে নি, সে সারা জীবনেও পারত না।”
“তাহলে এখন কী করতে বলেন? ওকে ক্ষমা করে দেব?”
“ভুলেও সে চেষ্টা করবেন না। কাওকে ক্ষমা করতে যাওয়া মানে নিজেকে তার চাইতে শ্রেষ্ঠ ভাবা। আপনি তাকে ক্ষমা করার কে? সে আপনার সাথে সুখী হয় নি, তাই অন্যখানে থেকে সুখ খুঁজে নিচ্ছে। তাকে সুখী করার দায়িত্ব এখন আর আপনার না। এখন সেটা ওই মেয়েটার দায়িত্ব। অতএব, আপনি ওকে সিম্পলি নিজের মন থেকে বের করে দেন। সব রকম দায় থেকে রাতুল আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে। চেষ্টা করুন, ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকার।”
চুপ করে থাকলাম। আজকে কথাগুলো মেনে নিতে কোন কষ্ট হল না। রাতুলকে এই মুহুর্তে পেলে সত্যি সত্যি একটা থ্যাংকস দিতাম।

২৬ নভেম্বর, ২০১২
গত দুইমাস মান্থলি চেকআপের জন্য আমি একাই এসেছি। আজ বিভু কিছুতেই আমাকে একা ছাড়ল না। ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। আমার সামনের সারিতেই খুবই সুন্দরী একটা মেয়ে বসে আছে। শুধু সুন্দরী বললে ভুল হবে, চোখেমুখে একটা অন্যরকম আবেদন আছে। আশেপাশে রোগীর সাথে আসা যেসব ছেলেরা অপেক্ষাকৃত কম দু:শ্চিন্তাগ্রস্ত, তারা বারবার মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে। তাদের চোখেমুখে আগ্রহের ছাপ স্পষ্ট। মেয়েরাও না তাকিয়ে থাকতে পারছে না। তাদের দৃষ্টিতেও সমান আগ্রহ, তবে সেটা খানিকটা ঈর্ষামিশ্রিত।
ব্যতিক্রম একমাত্র বিভু। খুবই মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। ওকে একটু জ্বালাতে খুব ইচ্ছে হল।
জিজ্ঞেস করলাম, “এ জগতে আসলে তো আমাদের মতই আপনাকেও মশা কামড়ায়, আপনারও ক্ষুধা লাগে। তাহলে এ ব্যাপারে এরকম সাধু সন্ত সেজে থাকার মানে কী?”
“কোন ব্যাপার? বুঝলাম না।”
“পুরো হল মেয়েটাকে হাঁ করে দেখছে। একমাত্র আপনি ছাড়া।”
“ও, এই ব্যাপার! পেট ভরা থাকলে আর অন্য কোন খাবারের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। তা সে যতই লোভনীয় হোক!”
মুখে বললাম, “খুব্ব্ই স্থুল ছিল উপমাটা!” কিন্তু বুকের ভিতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। ও কী বলতে চায়?
“সত্যি কথা সোজাসাপটা হওয়াই ভাল। বেশি সূক্ষœ হওয়ার দরকার কী?”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। এখনো জানি না, আমার ভিতরে যে বেড়ে উঠছে সে ছেলে না মেয়ে। আমার সিরিয়াল আসতে এখনো দেরি আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশে তাকালাম।
হঠাৎই দেখলাম, কাঁচের দরজার ও পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে আগে কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হল। তার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার ঘাড় এতক্ষণ ওপাশে ফেরানো ছিল, ছেলেটা এ পাশে মুখ ফেরাতেই বুঝলাম- ওটা রাতুলের ছোট ভাই মৃদুল। মেয়েটাকেও এবার চিনলাম। রাতুলের নতুন গার্লফ্রে-। সেই ইরানী মেয়ে। ফেসবুকে দেখেছিলাম। মেয়েটা আসলেই ভীষণ স্নিগ্ধ। মাথায় ঘিয়ে রঙ্রে একটা স্কার্ফ জড়ানো। গায়ে শর্ট বোরখা। কাঁধের ব্যাগটা বোধহয় দেশালের। মৃদুলের সাথে আরো কয়েকজন ছেলে আছে। কয়েকজনকে আমি চিনি। রাতুলের বন্ধু। দেখে মনে হল, সবাই-ই মেয়েটার পরিচিত। হ্যাঁ, রাতুলের জীবনের জন্যে এই মেয়ে সত্যিই ভীষণ মানানসই। কিন্তু ওরা সবাই দল বেঁধে হাসপাতালে কেন? রাতুলের কিছু হয় নি তো?
বিভুকে বলাতে ও রিসেপশন থেকে খোঁজ এনে দিল। রাতুলের ডেঙ্গু হয়েছে। এখানেই একটা কেবিনে ভর্তি আছে। এখন অবস্থা ভালোর দিকে। একবার ভাবলাম, আমার বোধহয় দেখে আসা উচিত। কিন্তু না, সেটা বোধহয় ঠিক হবে না। আমার যাওয়াটা রাতুল ভাল চোখে দেখবে না। যদি স্বাভাবিকভাবে কথা বলি, তাহলে ও ভাববে, নিজের শক্ত-পোক্ত ইমেজের বিজ্ঞাপন দিতে এসেছি। আবার বলা যায় না, ভেবে ফেলতে পারে যে, আমি এখনো ওর আশা ছাড়ি নি। না, সেটা ভাববে না, আমি নিশ্চিত। আমার শুদ্ধতার বাতিক ও জানে। নতুন রিলেশনশিপের পর ওকে আর কোনভাবেই গ্রহণ করা সম্ভব হবে না, এটা তো ওর চেয়ে ভাল করে কেউ জানে না।
যাহোক, মেয়েটাকে দেখে খুব নিশ্চিন্ত লাগল। রাতুলের পরিচিত বলয়ের মধ্যে ও যেভাবে মিশে গেছে, তাতে ওদের সম্পর্কটার মধ্যে অন্য কোন জটিলতা ঢোকার সুযোগ পাবে না। আমি সত্যিই মুক্ত। কোন মানবিকতার দায়ও আমার আর থাকল না। ভীষণ নির্ভার লাগল নিজেকে।
“চেকআপ করাবেন, নাকি আজ বাড়ি যাবেন?” বিভু জানতে চাইল।
“আজ থাক। ওরা কেউ দেখে ফেললে অহেতুক একটা জটিলতা তৈরি হবে। চলেন, চলে যাই।”
বিভু বাধা দিল না।

১২ ডিসেম্বর, ২০১২ (সন্ধ্যাবেলা)
বিভু আর কোনদিন আসবে না। সেটা অবশ্য আমারি ভুলের কারণে। ডায়েরিটা পাশে রেখে চুলাটা সেদিন ওভাবে জ্বালিয়ে রেখে যাওয়াটা ঠিক হয় নি। কিন্তু ঠিক কী করে যে জিনিসটা গিয়ে চুলার ঠিক মাঝখানে পড়ল, সেটা আমি এখনো ভেবে পাই না।
বিভুকে মিস করি, কিন্তু একাকীত্বের অসহায়ত্বটা এখন আর তেমন চেপে ধরে না। ও আমার পুরনো ‘আমি’টাকে জাগিয়ে দিয়ে গেছে। যে কোন কিছুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর মত মনের জোরটা এখন ফিরে পেয়েছি।
আমার কল্পনায় এখন দুটো স্রোত চলে। একটা আমার শরীরে বেড়ে ওঠা সত্তা, আর একটা হল কল্পনার সমস্ত রঙে রাঙানো বিভু। দুজনের কথা ভাবতে গেলেই আমার মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। এক্ষুনি দুজনকে একসাথে দেখতে ইচ্ছা করে। এক্স-রে করে যদি হার্টের ভেতরটা দেখা যেত, তাহলে নিশ্চয়ই দুজনকেই একসাথে দেখতে পেতাম।
টেবিলের উপরে অনেক জিনিসের স্তুপ হয়ে আছে। জিনিসগুলো গোছাতে শুরু করলাম। তখন র‌্যাপিং পেপারে মোড়া সেই গিফট-টা চোখে পড়ল। একটা সিডি। ড্রাইভে ঢোকাতেই বিভুর কণ্ঠস্বরে বেজে উঠল,
“বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন নদীর ধারে,
গহন কোন বনের ধারে,
গভীর কোন অন্ধকারে,
হতেছ তুমি পার
পরাণসখা বন্ধু হে আমার।”

2 comments

    • এটা অনেক পুরনো লেখা। আজ মনে হল, বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা আমার সব লেখাগুলো এই সাইটে জড়ো করে রাখি। তাই, জাস্ট পুরনো লেখাগুলো বসে বসে পোস্ট করছি। এই পোস্টগুলো কারো চোখে পড়ে যাবে ভাবিই নি! অনেক ধন্যবাদ, ভাইয়া। 🙂

      Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s