শেক্সপীয়র নামটি এবং নারীবাদ মতবাদটি কোনভাবেই সমবয়স্ক নয়। তাই এদুটো শব্দ একসাথে দেখলে একটু বিভ্রান্তিকর মনে হতেই পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভাবের জন্ম ভাষার আগেই হয়। তাই ‘সুন্দর’-কে সুন্দর বলে ডাকতে শেখার আগেই সদ্যজাত শিশু তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা রাখে। ঠিক তেমনি করে, নারীবাদ মতবাদটি বিকশিত হওয়ার বহু আগেই, শেক্সপীয়রের বিভিন্ন লেখায় এর নিদর্শন দেখতে পাওয়া গেছে। তবে “অ্যাজ ইউ লাইক ইট”, “দি মাচের্ণ্ট অব ভেনিস” এবং “ম্যাকবেথ”-এ এই ইস্যুগুলোর উপর তুলনামূলক বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রথমে “অ্যাজ ইউ লাইক ইট”-এর কথাই ধরা যাক। এখানে নায়িকা রোজালিণ্ডকে নায়ক অরল্যাণ্ডো দেখেছে সৌন্দর্যের প্রতিভূ হিসেবে। যত কবিতা নায়ক লিখেছে, যত প্রশংসাই সে করেছে রোজালিণ্ডের, তাতে কোথাও নায়িকার বৌদ্ধিক সামর্থ নিয়ে একটা লাইনও লেখা হয় নি। কারণ ‘প্রেমিকা’ নামক এই রমণীয় জীবটির যে বুদ্ধি নামক কোন বস্তু থাকতে পারে তা বেচারা নায়ক তার ঘোর দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করে নি। তাই, প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার পরে, অরল্যাণ্ডোর অভিব্যক্তি ছিল এরকম-“O poor Orlando! Thou art overthrown/Or Charles or something weaker masters thee” অর্থাৎ এতবড় কুস্তিগীর চার্লসকে হারিয়েও তার চেয়ে ঢের দুর্বল এক শক্তির কাছে তাকে হেরে যেতে হল, সেই দুঃখেই বেচারা কাতর। এখন পর্যন্ত সে শুধু রোজালিণ্ডের রূপটাই দেখেছে । তার মনের পরিচয় তখনো পায় নি বলেই সে তখনো জানে না, আরো কী কী হার তার কপালে অপেক্ষা করে আছে।
নাটকটি যাদের পড়া আছে, তাদের নিশ্চয়্ই এতক্ষণে মনে পড়ে গেছে যে, অরল্যাণ্ডোর কী দশা করেছিল পুরুষবেশী রোজালিণ্ড। মেয়ের পরিচয়ে বাইরে গেলে বিপদের আশঙ্কা। তাই, রোজালিণ্ড পুরুষের বেশে গ্যানিমিড নাম নিয়ে বনে এসেছিল। আর সেখানে গোটা বনটাই তখন চলছিল তার অঙ্গুলিহেলনে। অরল্যান্ডো রোজালিন্ডকে না পেয়ে গ্যানিমিডের প্ররোচনায় তাকেই রোজালিন্ড কল্পনা করে মনের কথাগুলো অকাতরে প্রকাশ করে যাচ্ছিল। আর রোজালিন্ডও নিজের পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রেখে অরল্যান্ডোর প্রকৃত মনোভাব যাচাই করে নিচ্ছিল। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, অরল্যান্ডো যখন দুঃখ ভুলতে গ্যানিমিডকে রোজালিণ্ড ভেবে প্রেম নিবেদন করছিল, তখন ছদ্মবেশী রোজালিণ্ড তাকে বারবার মেয়েদের অস্থিরচিত্ততা, সংসারজীবনের জটিলতা, পুরুষের ভালবাসার অসারতা নিয়ে সাবধান করে দিচ্ছিল। এই ডায়ালগগুলোর মধ্য দিয়ে রোজালিণ্ডের নিরপেক্ষ জীবনবোধ প্রকাশ পেয়েছে। সে নিজে মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তার স্বজাতির দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে পুরো মাত্রায় সচেতন। এই স্বচ্ছ চিন্তাপদ্ধতির কারণেই সে গোটা নাটকের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
এরপর আসে মার্চেণ্ট অব ভেনিসের কথা। এখানেও নায়িকার অনেক বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ আছে। কিন্তু এখানে নায়িকা পোর্শিয়া প্রত্যক্ষভাবেই ত্রাতার ভূমিকায় দেখা দিয়েছে। বাঘা বাঘা নামজাদা লোকজন যে মামলাটা নিয়ে তোলপাড় করে ফেলল কিন্তু কোন সুরাহা করতে পারল না, পোর্শিয়া এক নিমেষে তার সমাধান করে ফেলল তার কমন সেন্স দিয়ে। এখন প্রশ্ন হল, এতগুলো ছেলে থাকতে ঘরে থাকা একটা মেয়েকে দিয়ে এই সমাধান নাট্যকার কেন দেওয়ালেন? কারণ আর কিছুই না, কারণ হল সংকীর্ণতায় ঘা দেওয়া। সমাজ একটা মেয়ের মুখ থেকে এতখানি বুদ্ধিদীপ্ত জেরা আশা করে না, এমনকি আদালত কক্ষে তার ঢোকারও কোন অনুমতি নেই। তাই পোর্শিয়াকে পুরুষের ছদ্মবেশে সেখানে ঢুকতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত, তার স্বামী বাসানিও-র কাছ থেকে পুরস্কার হিসেবে আংটি নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি এবং সেই আংটি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রথমবারে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল। কিন্তু সমালোচকেরা এই দৃশ্যটির কয়েকটি অসাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রথমটি হল, ইহুদী শাইলকের বিচার দৃশ্য দিয়ে নাটক শেষ হয়ে গেলে নাটকের করুণ পরিণতির কারণে ভারি মন নিয়ে দর্শককে বাড়ি ফিরতে হত। আর ইহুদীর দুঃখ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি খ্রীষ্টান দর্শকেরা মেনে নিতে পারত না। সে কারণেই এই দৃশ্যটি কমিক রিলিফ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর একটি ব্যাখ্যা আছে। পোর্শিয়া বাসানিও-কে আংটিটি আমৃত্যু আঙুলে রাখার শপথ করিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বাসানিও বন্ধুর মামলা জেতার আনন্দে প্রতিশ্রুতি ভুলে উকিলবেশী পোর্শিয়াকে সেটা দিয়ে দিয়েছে। তাই, পোর্শিয়া যতই আংটির কথা জিজ্ঞেস করে, বাসানিওকে ততই সেই উকিলের প্রশংসা করতে হয় যাতে পোর্শিয়া ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারে। পোর্শিয়াকে সে বুঝাতে চাইল যে সে নিজে এবং তার বন্ধু অ্যাণ্টনিও সেই উকিলের কাছে চিরঋণী। আর এইসব সংলাপের মধ্য দিয়ে নাট্যকার মূলত পুরুষের মুখ থেকে নারীর বৌদ্ধিক সামর্থের স্বীকৃতি আদায় করিয়ে দিলেন।কারণ পরিচয় জানত না বলেই বাসানিও অত অকৃপণ প্রশংসা করেছে সেই উকিলের বুদ্ধির। আর পোর্শিয়াও পুরোদমে তার স্বামীর মুখ থেকে তার সুপিরিয়রিটির স্বীকৃতিটি আদায় করে নিতে পেরেছে। এই একই ব্যাপার অ্যাজ ইউ লাইক ইটের ক্ষেত্র্রেও ঘটেছিল। নারীর নারী রুপটি শুধু কোমলতা আর অধীনতার সমার্থ শব্দ হিসেবেই বিবেচনা করত তখনকার পুরুষেরা। তাই নারীর বুদ্ধি, বিবেচনার স্বাধীন প্রকাশ ঘটাতে পুরুষের ছদ্মবেশ নেওয়া ছাড়া গতি ছিল না।
ম্যাকবেথ নাটকে নারীর যে রুপ প্রকাশ পেয়েছে তাতে রীতিমত চমকে যেতে হয়। লেডি ম্যাকবেথ চরিত্রটি অত্যন্ত বিতর্কিত। কিন্তু এ চরিত্রটিও একটি বিরাট ধাক্কা তৎকালীন সমাজের জন্য। লেডি ম্যাকবেথ রীতিমত একটি ইভিল জিনিয়াস। নারীর এত নিষ্ঠুর রূপ কারো কাছেই প্রত্যাশিত নয়। কিন্ত শেক্সপীয়র জানেন, নারী বা পুরুষ কোন জাতই ভাল বা মন্দের একচ্ছত্র পেটেণ্ট নিয়ে রাখে নি। পদস্খলন যে কারোরই হতে পারে। তাই লেডি ম্যাকবেথ অন্যায় করেছে, ম্যাকবেথও করেছে। আবার সে পাপের শাস্তিও তাদের দুজনকেই পেতে হয়েছে।অন্যায়ের পরিণতি যেমন নারী পুরুষ মানে না, তেমনি অন্যায়ের প্রবৃত্তিও দু’ পক্ষের রক্তেই সহজাত। এই সত্যিটুকু শেক্সপীয়র আজ থেকে শত শত বছর আগেই বুঝে গেছেন, বুঝিয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা কি বুঝি? নারীর মানুষ রূপটি নিয়ে আমরা কি আদৌ সচেতন? নারীর সমস্যা অভিযোগ বা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলেই তাকে নারীবাদী অ্যাখ্যা দেওয়া হয়। ঠোঁট উল্টে বলা হয়, “ভারি নারীবাদী! মানবতাবাদী হতে তোমাদের সমস্যা কোথায়? অহেতুক বিভেদ সৃষ্টি করার দরকার কী নারী আর পুরুষের মধ্যে?”
এদের কথার উত্তরে আমার পাল্টা জিজ্ঞাসা–কেন? নারী কি মানুষের বাইরে? আর কে বলল যে নারীবাদ কথাটির মাধ্যমে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে! যে বিভেদ যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে তা চিহ্নিত করতেই এই বাদটির জন্ম দেওয়া হয়েছে। এটাকে অমানবতাবাদ ভাবার কোন সুযোগ তো নেই!
প্রকৃতিতে চিরদিন নানাভাবে সবলের দ্বারা দুর্বল নিপীড়িত হয়ে আসছে। কখনো অর্থশক্তির কাছে দারিদ্র্য, কখনো পেশীশক্তির কাছে রুগ্নতা, আবার কখনো পৌরুষের দাপটের কাছে নারীত্বের পরাজয় হচ্ছে। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বিশেষ বিশেষ সুবিধাবঞ্চত গোষ্ঠীর হয়ে কথা বলছেন। তারা সবাই-ই মানবতাবাদী। কিন্তু কে ঠিক কার কথা বলছেন তা বুঝতেই আমরা কাউকে কম্যুনিস্ট,কাউকে নারীবাদী বলে চিনে থাকি! এদের দায়িত্ব বিভেদ দূর করা। যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে পুরুষবিদ্বেষ প্রচার করেন, তাহলে সেটা তার ব্যক্তিগত সমস্যা। গোটা নারীবাদকে এর সাথে জড়িয়ে ফেলার কোন কারণ নেই।
একটা সমস্যা হল, আমরা মেয়েদের ব্যাপারে খুব বেশি সাধারণীকরণ করে কথা বলি। আজাকের বাংলাদেশে আমাদের দুই নেত্রীর কেউ যখনই কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেন কিংবা ভুলভাল মন্তব্য করেন তখনই শোনা যায়–“এইজন্যই বলে মেয়েমানুষের বুদ্ধি!” আচ্ছা, আমার একটি বিনীত জিজ্ঞাসা আছে। জেনারেল এরশাদ কোন ভুল করলে তখন তার পুরুষ পরিচয়টা উঠে আসে না কেন? তখন তো দিব্যি ধরে নিই যে, উনি মানুষটাই এমন!
আসলে বুদ্ধি বা বোকামিতে কোন জাতেরই একচেটিয়া অধিকার নেই। এই সহজ সত্যিটুকু বোঝার সময় কি এই একবিংশ শতাব্দীতেও আসে নি!
আপনার জন্য শ্রদ্ধা। মনের অনেকগুলো গিট্টু খুলে দিলেন।
LikeLike
আপনার জন্যও শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা রইল। 🙂
LikeLike
আসলে এই সমাজের মূল সমস্যা হলো আমরা যা দেখি না তাকে বিশ্বাসের বস্তু বানিয়ে বসে আছি। মুক্তমনের বিকাশের জন্য ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিতে হবে। কেননা সৃষ্টিকর্তা বিশ্বাস করলে মুক্তমন চর্চা অসম্ভব। আর মহানবী (সঃ) তো আমাদের মতো দ্বিপদ প্রাণী।
LikeLike
Feminism is such as a genderatic topics which can eradicate all of aggregation of religion.
LikeLike
বাংলাদেশের সর্বত্র নারীবাদের পতাকা উড়ুক। নারীরা পুরুষের সমকক্ষ হবে। নারীদের বোরখা উন্মুক্ত হবে। কায়েমীবাদ নিপাত যাবে। তাহলেই আগামীতে সুন্দর বাংলাদেশ পাবো আমরা। নারীরা জেগে উঠলেই জগৎ সুন্দর হবে। নইলে সমাজ দ্বিচক্র শকটের ন্যায় ঝুলে থাকবে। সমাজের এক পা উন্নয়নে গতিশীল ভূমিকা রাখবে আর আরেক পা ঘরকন্না ঠেলবে। সুতরাং সমগ্র পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রথাবদ্ধ সমাজ থেকে আমাদের বেরিয়ে এসে নতুনভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে হবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, নারীরা ঘরোয়াভাবে কেবল গৃহিণী পরিচয়েই এখনো থাকতে চাইছেন। কিন্তু সামাজিক ন্যায়-ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য নারীর সাম্য প্রতিষ্ঠায় ত্বরিত পদক্ষেপ জরুরী। আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে। ঠিক এমনে আমরা সামাজিক জাগরণ তৈরী করবো। কেউ কোনো ফতোয়ার শিকার হলে আমরা তাদের প্রতিহত করবো। পাড়ার মৌলবীদের মাঝে যে ধর্মের বীজ লুকায়িত, তা চিরতরে মুছে দিয়ে এই প্রথাবদ্ধ সমাজ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
LikeLiked by 1 person
তোমার সূচিন্তিত মতামত জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ, কুশল।
LikeLike
নারীরা পর্দা থেকে মুক্ত হবে। সমস্ত পুরুষতান্ত্রিকতাকে এখনই প্রশ্নবিদ্ধ করা হোক। সমাজে যতো পুরুষ প্রথা আছে, তা আজ ভেঙে ফেলা হোক।
LikeLiked by 1 person
বিশেষত বিংশ শতাব্দিতে যখন বিশ্ব সদ্য যুদ্ধমুক্ত, তখন ইউরোপের নারীরা গৃহ হতে বের হলো। তারা বাইরে এসেছিলো চাকরি করতে কারণ যুদ্ধে অধিকাংশের স্বামী না হয় বাবা মারা যায়। ফলে ইউরোপ-আমেরিকায় চরম দারিদ্র্য নেমে অাসে। পুরাতন কালের জরাজীর্ণ ভাষণ পরিত্যাক্ত হলো। মানবতা প্রতিষ্ঠিত হলো।
নারীবাদের প্রথম উন্মেষ ঘটান সিমোন দ্য বোভোয়ার। সে কারণে তাঁকে নারীবাদের আইনস্টাইন বলা হয়। প্রকাশ্যে নারীমুক্তির ঘোষনা দিয়েছিলেন নারীমুক্তির জোয়ান অব আর্ক মেরী ওলস্টোনক্রাফট। শেক্সপীয়র নারীবাদের ভাবের উন্মেষ করেছেন। তবে সে ভাব-মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছেন একালের নারীবাদীরা।
LikeLiked by 1 person