আমার এখন নিবিষ্ট মনে খাতা দেখার কথা। নিয়ত ঠিক করে সামনে খাতা ছড়িয়ে বসলাম্ও।নিয়তকে আরো মজবুত করতে ফেসবুক খুললাম- লগ আউট করার জন্য। নোটিফিকশনের কারণে যাতে আমি কিছুতেই লক্ষ্যচ্যুত না হই। সেকালে ধ্যানভঙ্গের জন্য ছিল রম্ভা, মেনকা আর এ কালে আছে ফেসবুক!
লগ আউট বাটন খুঁজে পা্ওয়ার আগেই হোমপেইজে চোখ আটকে গেল। স্ত্রী-পুত্রকে কোলে-কাখে-পাশে নানাভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিয়ে একটি হাস্যেজ্জ্বল ভদ্রলোকের ছবি। দেখে যেন মনে হল চিনি উহারে। ঠাহর করে দেখলাম- তিনি আমার এক সময়ের ক্রাশ! কিন্তু হায়! এ কী চেহারা উনার! আমার স্মৃতিতে এখনো ভাসছে একটা লম্বা, স্বপ্নীল চেহারা। কপালের অনেকটা অংশ ঢাকা থাকত চুল দিয়ে। চুলগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে, সে জায়গা জুড়ে একটি বিস্তৃত টাক!
উনার স্ত্রী-সন্তানকে দেখে আমার তো ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে যা্ওয়ার কথা! কিন্তু কই! ভদ্রমহিলার জন্য বরং গভীর সমবেদনা অনুভব করলাম। এই টেকো লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে হাসিমুখে পোজ দিতে হচ্ছে!
ঠিক সেই মুহুর্তে পিড়িং করে একটা শব্দ হল। না, ফেসবুক থেকে আসে নি শব্দটা। শব্দটা আসলো আমার অন্তরের গহীনতম প্রদেশ থেকে। অন্তরবুড়ো কমেন্ট করেছে! বলছে, “ঐ লোকের স্ত্রীকে সমবেদনা জানানোর তুমি কে? তোমাকে কে বলেছে যে মহিলার কোন অনুতাপ আছে তার স্বামীকে নিয়ে?”
“অনুতাপ থাকবে না কেন? আমার এত বছরের আকর্ষণ এক মুহুর্তে পালাল এই টেকো চেহারা দেখে! আর ঐ মহিলাকে তো রোজ এই ভুঁডিওয়ালা টেকো লোকটাকে নিয়ে কাটাতে হয়! আমার তো করুণা হচ্ছে দুজনার জন্য”
বুড়ো হা হা করে হাসল আমার কথা শুনে। আমার গা জ্বলে গেলে সেই হাসি শুনে। বুড়ো কোন পণ্ডিতিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার আগে এরকম একটা হাসি হাসে।
“তোমার আকর্ষণ পালাল কারণ তোমার কোন স্মৃতি নেই লোকটার সাথে! মানুষ হিসেবে সে কেমন তুমি জান না। তোমার স্মৃতিতে শুধু টুকরো টুকরো কয়েকটা ছবি ভাসে- করিডোর দিযে তার হেঁটে যাওয়া। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুমি দেখতে পেতে যে রিকশায় করে সে বই পড়তে পড়তে যাচ্ছে! এই তো তোমার স্মৃতি!তার সাথে জীবনে তোমার কখনো কথা হয় নি। তার পুরো নামটা্ও তো তুমি জানতে না! তাই ফেসবুকে সার্চ দিয়ে তো তুমি তো তাকে কখনোই খুঁজে বের করতে পারো নি! তাই বলছি, তুমি তাকে কোনদিন ভালবাস নি!”
“কী বল, বুড়ো? ভালবাসি নি? উনাকে দেখলেই আমার হার্টবিট বেড়ে যেত! কেমন একটা শিহরণ জাগত ভিতরে! স্বপ্নীল চেহারার সেই ছেলেটার উপর আমার প্রচণ্ড আকর্ষণ ছিল!”
“ঠিক বলেছ। আকর্ষণ ছিল। মুগ্ধতা ছিল। কিন্ত ওটা ভালবাসা ছিল না। ভালবাসা কখনো শিহরণে, উত্তেজনায় আটকে থাকে না। প্রথম পর্যায়ে এই ব্যাপারগুলো থাকল্ওে মুগ্ধতাটা ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর সেখনে শিহরণের জায়গায় শান্তি আসে।
অনেক সময় এমনও হয়, যাকে ভালবাসছ তাকে মিস করছ কিন্তু সে বাড়িতে আসার পর হয়তো সে নিজের মনে কাজ করে বেড়াচ্ছে, তুমিও আর এক ঘরে ব্যস্ত আছ নিজের কাজ নিয়ে। কিন্তু সে যে বাড়িতে আছে-এটুকুই তোমার জন্য বিরাট শান্তির কারণ। ভালবাসা মানে দুজন দুজনের দিকে রূপমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা নয়। ভালবাসা হল একসাথে স্মৃতির পাহাড় গড়ে তোলা, দুজন দুজনের দুর্বলতার সহায় হ্ওয়া।”
আমার বিরক্তি আরো একটু বেড়ে গেল। বুড়োর কথা যখন খন্ডন করতে না পারি তখন আমার এরকম হয়। মনে হয়, বুড়ো কখন থামবে।
বুড়ো বুঝতে পারল। একটু হেসে বলল, “সেই গল্পটা মনে আছে?এক মধ্যবয়সী মহিলা স্বামীকে মুগ্ধ করতে এক ফোটো এডিটরকে দিয়ে নিজের ন্যুড এডিট করিয়েছিল? সেই ন্যুডটা একদম নিখুঁত করে এডিট করা ছিল। কিন্তু তার স্বামী খুশি হ্ওয়ার বদলে ভীষণ মন খারাপ করেছিল।
ফটো এডিটরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, ‘আমার স্ত্রীর শরীরটা এডিট করতে গিয়ে আপনি তার শরীরে সন্তানধারণের দাগটা্ও মুছে দিয়েছেন। আপনি আসলে দাগ মোছেন নি, আমাদের সন্তানটাকে সে নয় মাস ধরে শরীরে লালন করেছে, সেই স্মৃতিচিহ্নটাকেই মুছে দিয়েছেন।ওর মুখের বলিরেখা মুছে দিয়েছেন। অর্থাৎ আমরা দুজন কতগুলো বছর একসাথে কাটিয়েছি, সেই সময়ের চিহ্নটাকে মুছে দিয়েছেন। এটা আসলে আপনার দোষ না। এটা আমারই দোষ যে আমি তাকে আমার ভালবাসাটা বোঝাতে পারি নি। আর তাই, তাকে আপনার দ্বারস্থ হতে হয়েছে আমাকে মুগ্ধ করার জন্য।’”
“বুঝলাম। ভালবাসা তখনি হয় যখন সেটা মুগ্ধতা ছাপিয়ে পরম নির্ভরতায় পৌঁছায়।”
“এই তো। এবার বুঝেছ। তবে তার মানে এই না যে ঐ একই সম্পর্কের মধ্য কখনো মুগ্ধতা আসবে না। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে মুগ্ধতা, শিহরণ বা উত্তেজনাই সম্পর্কের চরমতম লক্ষ্য নয়। উত্তেজনার জন্য তো মানুষ ড্রাগ নিলেই পারে। ভালবাসা তো কোন নেশা নয়।
ভালবাসা হল আমাদের আবেগ অনুভূতি, দুর্বলতা, সবলতাকে নিরাপদে রাখার মত একটা আশ্রয়স্থল। যে সেই আশ্রয়টা দিতে পারে, তার সাথেই ভালবাসা হয়। অনেক মানুষ উত্তেজনা আর শিহরণকে ভালবাসার লক্ষণ ভেবে একটার একটার পর একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে কিন্তু শান্তি পায় না।”
এইসব বয়ান শুনতে শুনতে দেখলাম, রাত অনেক হয়েছে। ক্রাশের চেহারার উপর তো অনেক আগেই অরুচি ধরেছে এবার নিজের শ্রবণশক্তির উপরও বিতৃষ্ণা এসে গেল। বুড়োর ভালবাসা ব্যাখ্যান আমার মাথায় বিশেষ না ঢুকলেও এটা বুঝলাম যে আমার খাতা দেখার কাজ সারা। বাসের মধ্য দেখতে গেলে তো আবার ফেসবুকে ভাইরাল আপা হয়ে যেতে হবে। যাক, কাল সকালে কলেজে গিয়েই দেখব।
এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমের মধ্যেও, স্বপ্নের ঘোরেও ব্যাকগ্রাউন্ডে বুড়োর বকবকানি ভেসে আসতে থাকল। ইস! কোথা্ও যদি একটা অফ্ বাটন থাকত বুড়োকে থামানোর! সেই অমোঘ অফ্ বাটনের নাম বোধহয় আমার মৃত্যু! এর আগে বুড়ো থামবে না।