স্বপ্নমঙ্গল (২)

কাউন্সেলরের চোখমুখে মৃদু একটা হাসি মাখানো। হাসিটা পুরোপুরি পেশাদার নয়। ক্লায়েন্ট তাতে খানিকটা আন্তরিকতা দেখতে পেল। ঐ আন্তরিকতার কারণেই লোকটাকে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কাউন্সেলর তাকে অনেক কিছু বলল। জীবনের অনিশ্চয়তা, লিপ অফ ফেইথ ইত্যাদি বিভিন্ন রহস্যময় শব্দ । তাকে বলল, জীবনের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ যেন কেউ নিজের হাতে না রাখতে যায়। আমাদের জীবনে একজন পরম নিয়ন্ত্রক আছেন তার উপর যেন বিশ্বাস রাখে।

ক্লায়েন্ট এবার একটু বিরক্ত হল। বলল, সবসময় তার ইচ্ছে বোঝা যায় না। আর নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ না নিলে কেউ তো কোন কাজে মোটিভেশনই পাবে না!
কাউন্সেলর এবার কিছু ছবি বের করলেন- বহু ছবি- অনেকগুলো ছেলে-মেয়ের একক ছবি। দেখ, এই মেয়েটার ছবি। মেয়েটা খুবই উচ্চশিক্ষিত। এবার এই ছেলেটাকে দেখ। এই ছেলেটা একটা হাইস্কুল ড্রপআউট। এই ছেলের বাড়ি আর এই মেয়ের বাড়ি যোজন যোজন দূরে। অথচ এদের কিন্তু একদিন দেখা হবে। মেয়েটা ছেলেটার কাছে কলম কেনার জন্য থামবে।
ছেলেটা জানতে চাইবে, “এতগুলা কলম নিয়ে কী করবেন?”
মেয়েটা বলবে, “তোমার জমে যাওয়া মাথায় সেটা ঢুকবে না। আমি একজন লেখিকা। আমার লিখতে ভাল লাগে।
ছেলেটা বলে, “ কী লেখেন?”
মেয়ে বলে, “যখন যা ইচ্ছে। এমনকিছু লিখতে চাই যাতে মানুষের জীবনের পরিবর্তন আসে।“”
এখন বলো, এই কলমবিক্রেতার সাথে কি এই মেয়েটার কোনকিছু হওয়া সম্ভব?
ক্লায়েন্ট বলল, “জীবনে যদি সিনেমার মত কিছু হয়, তাহলে সম্ভব।“”
কাউন্সেলর বলল, “না। হতেও পারে, নাও হতে পারে। জীবনে কখন কার সাথে তোমার দেখা হবে সেটা তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না কিন্তু তুমি তার জীবনে থাকবে কীনা সেটা অনেকটাই তোমার নিয়ন্ত্রণে। ছেলেটা এক মুহুর্ত আগেও ভাবে নি এরকম একটা ক্ষ্যাপাটে মেয়ের সাথে তার দেখা হবে। এবার সে তাকে ধরে রাখতে চাইবে কীনা এটা তার ব্যাপার। এবং তার পরবর্তী পদক্ষেপের উপর তার বাকিটা জীবন নির্ভর করছে।
ক্লায়েন্ট জানতে চাইল, “কিন্তু কার ভবিষ্যতে কী আছে তা জেনে আমি কী করব?
কাউন্সেলর তার একথার সরাসরি কোন উত্তর দিল না। তার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। বলল, এই কাগজে তোমার জন্য নির্দেশনা আছে। এখন খুলো না। পরে খুলো।
কাউন্সেলরের লেখা সেই কাগজটার লেখা একটুও বোঝা যায় নি। সেগুলো লেখা না হিজিবিজি আঁকিবুঁকি তাও বোঝা যায় নি। ক্লায়েন্ট কাগজটা নিয়ে এক ওষুধের দোকানে আসল। কে না জানে, যে কোন খারাপ হাতের লেখা বুঝতে ওষুধের দোকানই শেষ ভরসা। দোকানদার কাগজটা দেখে মুচকি হেসে বলল, “এই লেখা বোঝার জন্য বিয়ে করতে হবে।“”
এ আবার কি উদ্ভট কথা! দোকানদার তার বিরক্তিটা একটু উপভোগ করে বলল, “বিয়েও তো এই লেখাটার মতই জটিল, দুর্বোধ্য।“”
উফ্! এই লোকটা তার ব্যক্তিগত ফ্রাস্টেশন ঝাড়ছে। ক্লায়েন্ট বিরক্ত হয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আসল।
ঠিক সেই মুহুর্তেই হাতে, কাঁধে কয়েকটা ব্যাগ ঝুলিয়ে ছবিতে দেখা সেই মেয়েটা ওষুধের দোকানে ঢুকল। ক্লায়েন্ট ওকে দেখতে পেল না।
দোকানের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল মেয়েটা। কী মনে করে ফিরে আসল। দোকানের যে কাউন্টারে কলম পাওয়া যায়, সেই কাউন্টারে থামল। ফোটোগ্রাফের সেই ছেলেটা সেখানে বসে আছে। মেয়েটা বলল, “তোমার দোকানে যত কলম আছে, সবগুলো আমাকে একটা একটা করে দাও।
ছেলেটা জানতে চাইল, “এতগুলা কলম নিয়ে কী করবেন?”
মেয়েটা বলল, “তোমার জমে যাওয়া মাথায় সেটা ঢুকবে না। আমি একজন লেখিকা। আমার লিখতে ভাল লাগে।
ছেলেটা বলে, “ কী লেখেন?”
মেয়ে বলে, “যখন যা ইচ্ছে। এমনকিছু লিখতে চাই যাতে মানুষের জীবনের পরিবর্তন আসে।
ছেলেটা অবাক চোখে মেয়েটার কথা শুনছে। এমন সৃষ্টিছাড়া মেয়ে সে কখনো দেখে নি।
মেয়ে বলে, “আমি ঘুরতে যাব। একটু পরেই আমার ট্রেন আসবে।
ছেলে জানতে চায়, “কোথায় যাবেন?”
মেয়ে বলল, “জানি না। তবে ইচ্ছেমত ঘুরতে চাই। সেই অভিজ্ঞতাগুলো সব লিখে রাখতে চাই।
কলমগুলো প্যাক করা হয়ে গেছে। মেয়েটা কি এক্ষুণি দাম মিটিয়ে চলে যাবে?
ওরা কি জানে যে ওদের বলা এই লাইনগুলো পূর্বনির্ধারিত? ওদের কি আবার দেখা হবে? আমি অপেক্ষা করছি মেয়েটা যাবার সময় ছেলেটা কী করে তাই দেখার জন্য। ছেলেটা কিছু বলতে যায়।
হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। আমার মাথার মধ্যে প্রজেক্টরে যে দৃশ্যগুলো দেখছিলাম তা এক এক করে মিলিয়ে গেল।
গল্পের শেষটা জানা হল না। ক্লায়েন্ট চরিত্রটা ছেলে নাকি মেয়ে মনে করতে পারলাম না । ক্লায়েন্টের সাথে এই ছেলে মেয়েদের কি কখনো দেখা হবে? সে আসলে কী সমস্যা নিয়ে কাউন্সেলরের কাছে গিয়েছিল? ভারি অতৃপ্তি নিয়ে চোখ খুললাম। চোখ খুলে ছেঁড়া ছেঁড়া মাত্র এই কয়েকটা দৃশ্য মনে করতে পারলাম । অথচ স্বপ্নটা অনেক বিস্তারিত ছিল।
আধঘুমেই মেসেজ পাঠালাম একটা। জানালাম, আমার ইন্টারেস্টিং স্বপ্নটা আমি শেষ করতে পারি নি। তাই, আমার মন খারাপ।
সে সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ দেখল। বেচারা একটা মিটিংয়ে ছিল। কিন্তু বুঝতে পারল, আমার স্বপ্ন শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার সবরকম কাজের অধিকার সে হারিয়েছে। ফিরতি মেসেজে জানাল, “আমি একটু পরেই কল করে স্বপ্ন শুনে নিচ্ছি।
অতঃপর উপরের গোটা স্বপ্নটা তাকে শোনালাম। তারপর ঘ্যানঘ্যান করতে থাকলাম। স্বপ্নের বাকি অংশ আমি কেমন করে জানব? এই স্বপ্নটা এত অদ্ভূত কেন? আমি কেন এই স্বপ্নের কোন চরিত্র নই? আমি কেন তৃতীয় ব্যক্তির মত এই স্বপ্নটা দেখলাম? আমার সব স্বপ্নের মধ্যে তো আমি নিজে থাকি। এটাতে নেই কেন?
সে শান্ত হয়ে শুনল। তারপর ঐ স্বপ্নের মধ্যে আমি কোথায় ছিলাম সেটা বের করে দিল। এবং বলল, “গল্পের বাকি অংশ জানতে চাও? তুমি নিজেই লিখে ফেল বাকিটা। তারপর আমাকেও জানিও শেষটা তুমি কীভাবে করলে।
কথাটা আমার মনে ধরল। আমার অর্ধচেতন মনে ভেসে ওঠা গল্পের শেষটা হোক আমার সচেতন চোখের সামনে- আমার নোটবুকে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s