মনে রেখে দেব …

আমার সামনে একটা ফাঁকা ফর্ম। পূরণ করবার অবাধ স্বাধীনতা। একদম শুরুর দিকে রোল নম্বর ছিল বলে যে কোন বিষয় নেবার সুযোগ ছিল। বুঝতে পারছিলাম না কোনটা নেওয়া উচিত – আইন নাকি ইংরেজি।প্রথম প্রেম নাকি ভোলা যায় না। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসটা ভুলতে পারি না। ক্লাসে ঢুকতে দেরি হয়েছিল। ঢুকে দেখলাম, তিল ধারণের জায়গা নেই। স্যার আমাকে বলেছিলেন, “You should have brought your own chair.” এরপর উনি আমাকে তার টেবিলে বসার অনুমতি দিয়েছিলেন। সে এক অচিন্ত্যনীয় ব্যাপার! স্যার দাঁড়িয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। আর পুরো ক্লাসের মুখোমুখি বসে আমি একমাত্র প্রাণী পা ঝুলিয়ে টেবিলে বসে ক্লাস করছি।
এই ঘটনাটা আমার চিন্তার জগতে একটা বড় আলোড়ন তুলেছিল। কয়েকটা রিয়ালাইজেশন হয়েছিল সেদিন। এক- শিক্ষক -ছাত্রের সম্পর্ককে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক ভাবার কোন কারণ নেই। দুই- দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষেরা জোর খাটিয়ে শ্রদ্ধা আদায় করেন না। তারা অসীম স্বাধীনতা দিয়েও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারেন। স্যারের ক্লাসে পিন পতন নিস্তব্ধতা থাকত। তিন, সেদিনের ক্লাসে আমার আরো একটা রিয়ালাইজেশন- তথাকথিত গৎবাঁধা ফর্মালিটি না মেনেও ডিসিপ্লিন বজায় রাখা যায়। মনে হল, সাহিত্যের ক্লাসরুম হল ওড়বার আকাশ, নাক ডুবিয়ে পড়া মুখস্থ করার জায়গা নয়। এই ডিপার্টমেন্ট আমার সামনে আরো অনেক বড় বড় দর্শনের জানালা খুলে দিল। পরিচয় করিয়ে দিল শেক্সপীয়র, টি এস এলিয়ট, ভার্জিনিয়া উলফ, বার্টান্ড রাসেলের মত চিন্তাবিদদের সাথে। এদের লেখা আগেও পড়েছি কিন্তু এমন অসাধারণ বিশ্লেষণ করে পড়ার কথা কল্পনাও করি নি। পরিচয় হল ফখরুল আলম স্যার, মঞ্জুরুল স্যার, আশরাফ স্যারদের মত জাদুকরী ব্যক্তিত্বের মানুষদের সাথে। দেখলাম জেরিন ম্যাম, তাসনিম ম্যাম, রুবিনা ম্যাম, রেবেকা ম্যাম, নেভিন ফরিদা ম্যাম, বাতুল ম্যাম, ফারহানাজ ম্যামদের মত মমতাময় শিক্ষকদের। এই মানুষগুলো ঠিক যতটা তীক্ষ্ণধী, ততটাই মার্জিত। পুরো একটা অভিজাত প্যাকেজ।পেয়েছিলাম গম্ভীর কিন্তু আন্তরিক গাউস স্যারকে। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত এবং স্নেহপ্রবণ বিজয় স্যার, নীলিমা ম্যাম, প্রতীতি ম্যামকে। কেউ কোনদিন শিক্ষক হবার সুবাদে অতিরিক্ত আড়ম্বর দেখান নি।এই বিভাগে গিয়ে বুঝেছিলাম, শুধু বই নয়, গুরুতুল্য মানুষের জীবনও একটা অধ্যয়নের বিষয়। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, অন্য কোন বিভাগে যাবার সিদ্ধান্ত নিই নি। ফর্মের গায়ে ইংরেজি লিখেছিলাম।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় নয়। কোনদিন হবে এমন সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এত চমৎকার সুবিধাজনক লোকেশনে দেশের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয় আছে কীনা আমি জানি না। চারুকলা, পাবলিক লাইব্রেরি, টিএসসি, জাদুঘরের পাশে, আজিজ থেকে একটু দূরে, ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এই ক্যাম্পাস। আমার মনে পড়ে, বিজয় স্যার বলেছিলেন, পড়বে তো অবশ্যই। কিন্তু প্রাণভরে ক্যাম্পাস লাইফটা উপভোগ কর। মুভি দেখ, আর্ট গ্যালারিতে যাও। ভাল ছবি দেখ, বই পড়। নিজেকে সমৃদ্ধ কর।আসলেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কেউ যদি শুধুই বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে কাটায়, তাহলে তার চাইতে বড় অপচয়কারী আর হয় না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এক টাকার চা খেয়েছি। ২৫ টাকা বার্ষিক ফি দিয়ে সারা ঢাকা ঘোরার স্বাধীনতা পেয়েছি। এই প্রিভিলেজগুলো পেয়ে আমার এতটুকু লজ্জাবোধ নেই। অসীম কৃতজ্ঞতা আছে। আমার সবসময় মাথায় থাকে, সামর্থ থাকা সত্ত্বেও আমার মা-বাবাকে তেমন কোন টাকা খরচ করতে হয় নি আমার জন্য। নাম না জানা অসংখ্য কৃষক-শ্রমিকের অবদান আছে আমার লেখাপড়ার জন্য। আজ সরকারি কলেজের শিক্ষক হবার পরে আমার স্কিলটুকু আমি তাদের সন্তানদের জন্য কিছুটা হলেও কাজে লাগাতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ক্লাসি হতে দিল না। ফুটপাথের উপর কিংবা ঘাসের উপর বসে বসে বাসের অপেক্ষা করতাম। এটা এমন এক অদ্ভূত জায়গা যেখানে শিল্পপতির সন্তান থেকে শুরু করে রিকশাযওয়ালার সন্তান সবাই নির্বিচারে এক টাকার চায়ে চুমুক দিতে থাকে। আর কয়েকটা বছর পরই জীবনের সমস্ত সমীকরণ হয়তো এলোমেলো হয়ে যায়। কিন্তু মনের কোথাও এক জায়গায় এই স্মৃতিগুলো রয়ে যায়। আমার মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনো সেই ঘাসের স্মৃতি, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির করিডোরের স্মৃতি; শিকড় থেকে দূরে যাবার কথা তাই ভাবতে পারি না। ঢাবির অনেক কৃতজ্ঞ বিনীত সন্তান আছে। আবার হতাশায় নিমজ্জিত বিপথগামী সন্তানও আছে। একই ফুল থেকে মৌমাছি মধু নেয়, মাকড়সা বিষ। ঢাবি কারোর দায় এড়াতে পারে না, এড়ানো উচিত নয়।সহস্রায়ু হও, ঢাবি। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে চিরতরে তোমাকে মনে রেখে দেব…

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s