তারা কেউ আমার ছায়া নয়। আমিও তাদের ছায়া নই। কিন্তু আমি তাদের ছায়ায় ছায়ায় চলছি। কখনো কখনো তারা আমার ছায়ায় ছায়া মিলিয়ে দিয়ে দাঁড়ায়- আমাকে আগলে রাখার জন্য। কখনো আমি দাঁড়াই তাদের ছায়ায়।
বড়বেলা, অর্থাৎ বয়স্কবেলার বন্ধুত্বগুলো খুব অন্যরকম। জীবনে একটা সময় আসে যখন সহকর্মীরা জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে- খানিকটা ভাল লাগা জুড়ে, অনেকটা খারাপ লাগা জুড়ে। কর্মজীবনে চাইলেই কোনকিছু ছেড়েছুড়ে চলে আসা যায় না। ছোট্টবেলার মত নাকের পাতা ফুলিয়ে ‘তুমি আমাকে না দিয়ে চকলেট খেলে তো! তোমার সাথে আড়ি!’ -বলে চলে আসা যায় না। আঙুলে আঙুলে বুলিয়ে কাট্টি নেওয়া যায় না। ছাত্রজীবনে কখনো কখনো বন্ধু বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে।কিন্ত কর্মজীবনে সহকর্মী বাছার সুযোগ থাকে না।
কিন্তু প্রতিদিন ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক, আর অভ্যাসবশতই হোক, আমরা অনেকগুলো ঘন্টা সহকর্মীদের সাথে কাটাই৷ ডেস্কজবের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো নিবিড়। প্রতিদিন আট/দশ ঘন্টা কয়েকটা মানুষের সাথে মুখোমুখি/পাশাপাশি বসে কাটে। মনের অজান্তেই তাদের মুখের রেখাগুলোর সাথে আমরা পরিচিত হয়ে যাই। সে রেখায় এতটুকু বদল হলে আমরা বুঝে ফেলতে শুরু করি। গলার স্বরের এতটুকু উত্থান-পতনও আমাদের কান এড়ায় না। ভালো লাগুক বা না লাগুক, নিজের অজ্ঞাতসারেই একটা মায়ায় জড়াতে থাকি আমরা। পরিবার একটা বন্ধন, কাজের জায়গা আর একরকম বন্ধন। এই মানুষগুলো প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আপনাকে দেখতে অভ্যস্ত। তাই, আপনার অনুপস্থিতি তাদের চোখে খুব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আপনি যদি তাদের প্রিয় না হন, তবুও।
আমার কাজের স্মৃতি বেসরকারি আর সরকারি- দুভাগে বিভক্ত। লক্ষ্য করেছি, সহকর্মীদের অনেকেই আস্তে আস্তে সহমর্মী হয়ে উঠেছেন। কেউ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেন্টর, কেউ গার্ডিয়ান, কেউ সঙ্গী, কেউ যে কোন প্রয়োজনে প্রথম ভরসাস্থল হয়ে উঠলেন। পরিবারের বাইরে এ-ও আরেক পরিবার।
গভীর বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি, সব কিছু শেয়ার করতে পারার মত বন্ধুগুলোকে আমি আমার দুই কর্মস্থল থেকে পেয়েছি।দেশ-কাল-বয়সের সীমানা ডিঙোনো বন্ধুত্ব। অথচ বন্ধুত্ব বলতে মানুষের চোখের সামনে সাধারণত ছাত্রজীবন ভেসে ওঠে। আমারও আনন্দের স্মৃতি আছে ছাত্রজীবনের বন্ধুদের সাথে। কিন্তু কর্মজীবন আমাকে কিছু পরিণত বন্ধুত্বের স্বাদ দিল। নিজের অর্থনৈতিক এবং পরিবারিক রেসপনসিবিলিটি নিতে অভ্যস্ত এই মানুষগুলোর কেউ কেউ অন্যের অনুভূতি ডিল করার ক্ষেত্রেও খুব পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে থাকেন।
এই মায়ায় জড়ানো মানুষগুলো দু:সময়ে আমাকে আগলে রেখেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আমার সমবয়সী। আমার বেহিসেবী জীবনে কোন অঙ্ক মেলে না। এদেরই একজন আমার অঙ্ক মেলায়। নিজে জ্বরে ভুগতে ভুগতেও আমার বেতন-বোনাসের হিসাব কষে দেয়। সাগরে দাঁড়িয়ে আমি স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার মুহুর্তে নিজেকে বিপন্ন করে আমার হাতটা ধরে রাখে।
কেউ কেউ বয়সে, অভিজ্ঞতায় অনেক বড়। তাদের বন্ধু বলে ডাকাটা আমার ধৃষ্টতা হবে হয়তো। কিন্তু বিপদে তারা অকৃত্রিম বন্ধুর পরিচয়ই দিয়েছেন।
আমার সকল সহমর্মী বন্ধুদের বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: আমার সব বন্ধুরা আমার প্রিয়। কিন্ত ২০১৫ সালের পরে আমার জীবনে আসা বন্ধুদের নিয়ে কিছু লেখা হয় নি। তাই, লিখলাম। এটিকেটনির্ভর এই বড়বেলায় সবার ছায়াকে ক্যামেরাবন্দী করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু আমার লেখাটুকু তাদেরকে ধারণ করে আছে। বন্ধু দিবস আজ নাকি ৩০ জুলাই- সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।




খুব ভালো লিখেছেন।
LikeLiked by 1 person
ধন্যবাদ আপনাকে।
LikeLike