খুবই ফেমিনিস্ট এবং সারকাস্টিক একটা ঘটনা ঘটে গেল চোখের সামনে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। দেখলাম, এক মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গোসল করছে। এটা গ্রামের পুকুরঘাট না। শহরের ফুটপাথ। এখানে এরকম দৃশ্য বেশ বিরল। কৌতুহলী লোকজন আশেপাশে ভিড় করেছে। একপাশে শুকনো কাপড়-চোপড় রাখা। আমি কাছাকাছি আসতে আসতে মেয়েটা ততক্ষণে কাপড় চোপড় বদলাতে শুরু করেছে। ভয়ানক ব্যাপার! ব্যাপারটা আমার জন্য আরো বেশি ভয়ানক হয়ে উঠল যখন দেখলাম যে, মেয়েটা আমার পরিচিত। আমার অফিসের জুনিয়র কলিগ।
হায় হায়! আমার এখন কী করা উচিত? মেয়েটাকে নিশ্চয়ই থামানো উচিত। আমি ওর নাম ধরে ডাকলাম। মেয়েটা কী এক অভূতপূর্ব কায়দায় উপরের কামিজটা বদলে ফেলেছে। ছেলেরা যেমন করে লুঙ্গি পরা অবস্থায় প্যান্ট ছাড়তে পারে-সেরকম ভাবে। কিন্তু কামিজের ক্ষেত্রে কী করে সেটা সম্ভব হল আমি ঠিক বুঝলাম না। পোশাক পরিবর্তনের এমন কোন কায়দা আমার জানা ছিল না। চোখে দেখেও ব্যাপারটা ঠিক বাস্তব মনে হচ্ছে না।
এবার সে পাজামা বদলাবে। এমন সময় দেখা গেল ফুটপাথের ওপাশে তিনজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তাদের মধ্যে একজন এই ঘটনার ভিডিও করছেন। আমি গিয়ে মেয়েটাকে ওখান থেকে সরিয়ে আনছি এমন সময় ওই মেয়েটা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, “গায়ের পোশাক দেখে তো ভদ্রলোক মনে হয়, একটু আগে একটা দরকারে কথা বলতে গেছিলাম তোর সাথে। এমন ভাব করলি যেন তুই কোন নবাবজাদা। নবাবজাদা ছাড়া কথা বলিস না। এখন ভিডিও করতে আসছিস যে? এখন খুব মজা লাগছে আমাকে দেখতে?
লোকটা খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সাথে থাকা বাকি দুই তাবেদারও চুপসে গেল। তবে এই শ্রেণীর লোকেরা খুব দ্রুত ফর্মে ফেরার চেষ্টা করে। এবং সেটা অবশ্যই নোংরামির মাধ্যমে। এই লোকটাও তার ব্যতিক্রম নয়। কুৎসিত গালাগালি আরম্ভ করল।
মেয়েটাকে আমি সরিয়ে আনলাম। অফিসে প্রায়ই দেখেছি ওকে। কিন্তু কথা বলা হয় নি। আজকে ওর প্রতিবাদী রূপটা দেখে ওর সম্পর্কে খানিকটা ধারণা হল। ও আমাকে বলল, ম্যাডাম, আমাদের বাসায় আসেন। আমি গেলাম ওর সাথে। দেখলাম, আরো অনেক স্টাফই ওই একই বিল্ডিংয়ে থাকে।
বেশ কিছুদিন আগে এক স্টাফ আমার কাছ থেকে একটা বই ধার করেছিল। ফটোকপি করে নিতে চেয়েছিল। তাকেও দেখতে পেলাম। তার কাছ থেকে বইটা ফেরত নিলাম। আমার বই কারো কাছে ফেলে রাখতে কেমন অস্বস্তি হয়। ওদের ঘরের বাইরে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় একটা ছেলে আমার কাছে এসে বইটা দেখতে চাইল। এই ছেলেটা আমাদের কোন স্টাফ নয়। আমি ওকে চিনি না। আমি বইটা ওকে দিলাম না। ছেলেটা বেশ রেগে গেল। দেখলাম, সে এবার ওই ফ্লোরেই আমাদের এমডির ঘরে ঢুকে গেল। এমডিকে দরজার বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল না। ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছিল। আমার দিকে আঙুল দিয়ে কিছু বলছিল।
এমডি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি ভিতরে গিয়ে চমকে উঠলাম। এমডির চেয়ারে এ কে? এই লোক তো আমাদের এমডি নয়! এই মূহুর্ত থেকে মনে হতে লাগল, আমি স্বপ্ন দেখছি। উনার চেহারা, কথা বলার ভঙ্গি সবটাই কেমন অদ্ভূত। উনি আমাকে চেনেন না। আমিও উনাকে চিনি না। কিন্তু উনি আমার বিচার করতে বসে গেলেন। বললেন, “আপনি অফিস টাইমের বাইরেও স্টাফদের সাথে মেলামেশা করছেন। তাদেরকে জার্মান শেখার বই ধার দিচ্ছেন। তার মানে, তাদেরকে আপনি চাকরি ছেড়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করছেন। আপনার কথার বলার ধরণটাও একটু কেমন কেমন যেন।”
এইসব যুক্তি খুবই অদ্ভূত লাগল। যেহেতু বুঝে গেছি, এটা স্বপ্ন, অতএব, এখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য চোখ খুলে ফেললাম। চাইলে, আরো কয়েক মূহুর্ত লুসিড ড্রিমিং করা যেত। কিন্তু ইচ্ছে হল না।
চোখ খু্লে আমার ওই জুনিয়র সহকর্মীর কথা ভাবতে লাগলাম। এরকম অদ্ভূতভাবে ও রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেন পোশাক পরিবর্তন করছিল? সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্ট? আজকাল এরকম ভিডিও বানানোর একটা ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। কিন্তু এই মেয়েটা আমার আগের জেনারেশনের। তার বয়স, সামাজিক অবস্থান, আর্থিক সঙ্গতি কিছুই এই সোশ্যাল ট্রেন্ডের সাথে মানানসই না। তাহলে স্বপ্নে এরকম অদ্ভূত ব্যাপার কেন দেখলাম?
আমি নিজে এধরণের সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্টের ভিডিও খুব একটা দেখি না। আজকাল ভাইরাল হওয়ার জন্য, আলোচনায় থাকার জন্য মানুষ যা নয় তাই করছে। আমার স্বপ্নে দেখা মেয়েটা প্রতিবাদী ছিল কিন্তু তার এই প্রতিবাদের আগের ঘটনাটার কোন যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পেলাম না। অবশ্য তার এই কাজের আগেও ঐ লোকগুলোর সাথে তার কী যেন হয়েছিল। সেই ঘটনাটা তো আমার জানা হয় নি। তবুও মেয়েটার এই কাজটা আমার কাছে উদ্ভটই মনে হচ্ছিল।
আজকাল অ্যাটেনশন সিকিং, ফেমিনিজম, যৌক্তিক প্রতিবাদ, ট্রোলিং, রোস্টিং- সবকিছু একাকার হয়ে গিয়ে মানুষের পার্সপেক্টিভগুলো কেমন গুলিয়ে গেছে। এই পোস্ট-মর্ডান যুগে একই ঘটনার শতরকম ব্যাখ্যা থাকে। সবাই নিজের নিজের যুক্তি খুবই গ্রহণযোগ্য ভঙ্গিতে দিতে থাকে।
আবার স্বপ্নের পরের অংশে নিজেই কেমন একটা আজব বিপদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছিলাম। পরিচিত এমডির জায়গায় অচেনা এমডি। একই বিল্ডিংয়ে কর্মচারীরা বাস করছে, এমডি অফিস করছে। স্বপ্ন বলেই সম্ভব।
তবে আজকের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মধ্যে থেকে কী অনায়াসে বেরিয়ে এলাম। চোখ খুললাম। দুঃস্বপ্ন মিলিয়ে গেল। বাস্তবটা এমন কেন হয় না?