একটা সময় ছিল যখন শুধুই প্রকাশকের হাত ধরে লেখা প্রকাশ করতে হত। শুধুই গ্যালারি মালিকের মাধ্যমে চিত্রকলার প্রদর্শনী করতে হত। কেবলই সিনেমা হলের মাধ্যমে সিনেমা দর্শকের কাছে পৌঁছত।
আর তারপর এল ব্লগ, ফেসবুক। সত্যিকার শিল্পী এবং স্বঘোষিত বা ‘স্বভাবিত’ শিল্পী উভয়েই সরাসরি অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছতে পারছেন। এতে করে তথ্য বা শিল্পের একটা মহাপ্লাবন তৈরি হয়েছে নেট দুনিয়ায়।
পাঠকের চাইতে লেখক বেশি। দর্শকের চাইতে পার্ফরমার বেশি। সারাদিন আঙুলের ডগায় বিনোদন। স্ক্রোল করে যাচ্ছি একটার পর একটা পোস্ট। কারো রান্না, কারো বাচ্চার আধো আধো বোলের কবিতা, কারোর মোটিভেশনাল পোস্ট। কারোর যুগান্তকারী প্যারেন্টিং টেকনিক, কারো কাঁচা হাতের শিল্প সাধনা, কারোর বিশাল বিশাল লম্বা-চওড়া পোস্ট, ভাইরাল ইস্যু নিয়ে কারোর তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ, কারো দূরদর্শী আলোচনা। কারোর পরলৌকিক গবেষণা এবং সেইসাথে ‘এ জগতের সকল হাসিখুশি আনন্দপ্রিয় মানুষ নির্বোধ’ শীর্ষক বক্তব্য।
এতে করে শিল্পের, আনন্দের প্রকাশভঙ্গি এবং প্রকাশমাধ্যমের উপর কারো একচেটিয়া খবরদারি করার সুযোগ কমে যাচ্ছে। তাতে কি ভালো হচ্ছে? হয়তো হচ্ছে। কিছু সত্যিকার প্রতিভা হয়তো এই অবারিত মাধ্যমে নিজেকে মেলে ধরবে। কিন্তু ভাইরাল আর ট্রেন্ডিং জোয়ারে ট্রোলই বেশি জনপ্রিয়। এসবের মধ্যে তাই হিরো আলমরাই উঠে আসে।
এই সুপ্রাপ্য বিনোদন তাই দিনশেষে আমাদের ক্লান্ত করে, রিল্যাক্সড করে না। আমরা বিনোদিত হতে হতে ক্লান্ত। তবু অভ্যাস টেনে নিয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালে। বন্ধুর কমেন্টের উত্তর দিতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলি। কথা ফুরিয়ে যায়। এই পোস্ট-মডার্ণ সমস্যার সমাধান হয় ইমোজি দিয়ে। প্রেম, রাগ, দুঃখ সবটাই যেহেতু ছাড়া ছাড়া, তাই, ইমো খুব ভালো কাজ দেয়। স্ট্রেইট ফেইস নিয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার ইমো দিয়ে সামাজিকতা রক্ষা করি।
ভার্চুয়াল রিয়ালিটি বাস্তবের যে ছায়া বানায় সেখানে কিছুক্ষণ থাকতে থাকতে মনে হয়, শুধুই ক্লান্তি সত্য, অসীম ক্লান্তি। অন্তর্গত রক্তের মধ্যে মিশে যাওয়া গভীর অবসাদই কেবল সত্য।
জীবনকে বারোয়াড়ি করে উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরে অন্যের জাজমেন্টাল অ্যাটিচিউড দেখে বিধ্বস্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়।
শেষমেষ দেখা যায়, পুরনো নিয়মের প্রেমেই মুক্তি। পুরনো নিয়মের বন্ধুত্বেই আনন্দ। একান্ত অনুভবই চিরস্থায়ী। একান্তে করা সাধনাই মনের ক্ষুধা মেটায়।