সবারে আমি নমি

স্মৃতির একটা গন্ধ থাকে। যেমন আমার এই স্মৃতিতে আছে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে কফি বানানোর গন্ধ। নিজের জন্য বানালে আরো কয়েকজনকে দিতাম। কখনো কখনো চমকে দিতে তারাও আমাকে বানিয়ে দিত। নিজের জন্য বানালে কখনো কখনো এমডিকেও দিতাম। কোন কোন দিন ফ্রেঞ্চপ্রেসে কফি ভিজিয়ে চলে আসতাম। ভুলেই যেতাম কফির কথা। তখন এম ডি নিজেই আমার কাপে কফি ঢেলে আমাকে দিয়ে যেতেন। উনি জানতেন, আমি একটু অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড। হাসিমুখে কাপটা নিয়ে এসে বলতেন, ইউ ফরগট সামথিং, রাইট?
এই স্মৃতিগুলোর ঘ্রাণ তো আছেই।
স্মৃতির নিজস্ব কিছু সুর আছে। কাজের সময় চারপাশের অ্যামবিয়েন্সটা মিস করি। সহকর্মীদের কলরোলটা মিস করি।

স্মৃতির কত স্বাদ আছে। জিভ দুপরের সেই ঘন ডালটা মিস করে। হোসেন ভাই আর ভাবীর মত করে অফিসে অমন ঘরোয়া রান্না কে করে দেবে? কোন সহকর্মী বাড়ি থেকে বিশেষ করে ভালোবেসে রান্না করে আনত। চুপচাপ আমার ডেস্কে বাটিটা রেখে যেত। সেগুলো মিস করি।

সমস্যা, স্ট্রাগল শেয়ার করার মত অসম্ভব ভালো কিছু বন্ধু ছিল। আমি তাদের মুখের রেখাগুলো চিনতাম। তারা আমারটা চিনত। টানা আট ঘণ্টা মুখোমুখি বসে থাকলে না চিনে উপায় নেই। সে রেখার এতটুকু বিচ্যুতি আমাদের চোখ এড়াত না। কাজের সময় যার সাথে বারবার বিরোধ হয়েছে, তার জন্যও কোথায় যেন একটা মায়া লেগে থাকে। সাথে থাকলে বোঝা যায় না। ছেড়ে যাওয়ার সময় বোঝা যায়। দৃশ্যমান অনুপস্থিতিটা বড্ড চোখে লাগে।
স্মৃতিতে কত স্পর্শ লেগে আছে। টেবিলের, চেয়ারের, ফাইলে ভরা ড্রয়ারের।আমার কীবোর্ড, আমার কম্পিউটার। কিন্তু সেগুলো আসলে কিছুই আমার ছিল না। যে যখন থাকবে, এটা তার।
কাজের জায়গা আমাদের অস্তিত্বের একটা অংশ। আজো আমি চোখ বন্ধ করলে দেখি, আমার প্রথম কাজের জায়গাটা আমার সচেতন আর অবচেতন মনকে যতখানি জুড়ে আছে, অতখানি জায়গা আর কিছুই আমার মনের মধ্যে নিতে পারে নি। কয়েক বছর ধরে ৮টা ঘণ্টা যে জায়গাটায় থাকতাম, সেখানে একটা অ্যাটাচমেন্ট রয়েই যায়। সেই জায়গাটা ছেড়ে আসার সময় খেয়াল হয়, যাকে খুব অপছন্দ করতাম বলে মনে হত, তাকেও আসলে মিস করব।

ঐ অফিসে পরবর্তীতে আবারো যাওযা পড়েছে। গিয়ে লক্ষ্য করলাম, আমি এই জায়গাটা আর মিস করছি না। এখন এই দেয়ালের রং বদলে গেছে। পরিচিত মানুষগুলো আমরাই মত ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় চলে গেছে। শুধু দু’ একজন পুরনো মানুষ আছে। বুঝতে পারলাম- আমি আসলে সবকিছু মিলিয়ে আমার ফেলে আসা সেই বিসিএমকে মিস করি- যেটা আমার চেনা। নতুনে ঘেরা এই নতুন প্যাকেজের সাথে আমার কোন স্মৃতি নেই। আমি এই জায়গাটা মোটেও মিস করছি না। আমি আমার মাথায় থাকা আইডিয়াল ভার্সনকে মিস করছি।

হুম। এবার গানটা গাওয়াই যায়। চলে এলাম তাতে কী? নতুন একটা পেয়েছ।
আমি কি নতুন একটা পাবই? তিন বছর আগের এই দিনে আমি জানতাম না পাব কীনা। একটা অনিশ্চয়তায় ভরা ছিল তিন বছর আগের সেই দিন।
কিন্তু চাকরিটা ছাড়তেই হত। তারা জানতেন যে আমার নতুন চাকরির রেজাল্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তখনো গেজেট হয় নি। সবাই অবশ্য জানে যে গেজেট না হওয়া মানে অনিশ্চয়তা তখনো কাটে নি।
পুরনো অফিসের ফেয়ারওয়েল নিয়ে বের হলাম। নতুন চাকরিটা যে হচ্ছেই তার কোন নিশ্চিত খবর না পেয়েই আগেরটা ছাড়লাম। একটা উবার নিলাম। উবারের মধ্যে বসে পোস্টটা চোখে পড়ল। বহু প্রতীক্ষীত গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে আমার নামটা স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে।
একটা দরজা বন্ধ না করলে অন্য দরজাটা খোলে না। কথাটা পুনর্বার প্রমাণিত হল। পুরনো পাঠ সম্পূর্ণ চুকিয়ে দেওয়ার পরই কেবল আল্লাহ্ দেখালেন, তিনি সবকিছু সময়মত ঠিক করে রেখেছেন।
আচ্ছা! নতুন একটা পেয়ে গেলাম। তুমিও পেলে। আমিও পেলাম। উইন-উইন।
এখন বুঝি, স্মৃতির মত বাস্তবটাও সুন্দর হতে পারে। পুরনো স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকলে নতুন স্মৃতি তৈরি করা যায় না। আজকের এই গেজেট দিবসে সবারে আমি নমি।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s