হাওয়া ও একটি অতৃপ্ত জনগোষ্ঠীর নাটক-ভাবনা

আমরা ভাবি, সিনেমা সমাজের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সিনেমা সম্পর্কে মানুষের মতামতই হলো সমাজের আসল প্রতিচ্ছবি। হাওয়া নিয়ে নানা মুনির নানা মত সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাইকোলজিকে খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।

আমরা একটা হতাশ, হীনম্নন্য, ঈর্ষাকাতর সমাজে বাস করি। বেশিরভাগ মানুষই এখানে বুকের মধ্যে হতাশা পুষে অত্যন্ত ছাপোষা জীবন যাপন করি। সিনেমাটাও এই জনগোষ্ঠীর কাছে স্বপ্নপূরণের একটা সাময়িক মাধ্যম। বড় পর্দার গায়ে আমরা কিছুক্ষণের জন্য আমাদের অতৃপ্ত বাসনাগুলো চরিতার্থ হতে দেখতে চাই। আমরা অন্যের উন্নতি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। প্রতিষ্ঠা না পাওয়ার বেদনা, সমাজের উঁচুতলায় উঠতে না পারার দুঃখ আমাদের পীড়িত করে। আমরা নানাভাবে এই দুঃখ মোচনের চেষ্টা করতে থাকি। কখনো সন্তানকে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখি। আবার কখনো বড় পর্দায় নায়কের অতিমানবীয় কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে আমরা কিছুক্ষণের জন্য রিলিফ খুঁজি।

এই অঞ্চলের মানুষের কাছে সিনেমা মানেই একটা লার্জার দ্যান লাইফ ব্যাপার স্যাপার।হিরোর অসাধ্য বলে কিছুই থাকবে না। হিরো সারাদিন ট্যাক্সি চালিয়েও বছর শেষে মায়ের কাছে ছুটতে ছুটতে এসে বলবে, ‘ মা মা, আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি। নায়িকাকে বীর বিক্রমে ঢিশুম ঢাশুম অ্যাকশন সিন করে গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচাবে। অত্যন্ত সাধারণভাবে চলাফেরা করবে, আবার হঠাৎ করে বড়লোকদের সামনে গড়গড় করে ইংরেজি বলে তাদের চমকে দেবে। নাচে, গানে অদ্বিতীয় হবে। যখন পর্দার দরিদ্র নায়ক বড়লোক নায়িকাকে জয় করে আনে তখন আমরা উল্লসিত হই। তাঁর প্রতিটা অবাস্তব জয়ের মধ্যে দিয়ে, আমাদের অপূর্ণ সাধ পূরণ হতে থাকে। টিকিটের টাকা উসুল হতে থাকে।

মানুষের এই ছকে বাঁধা প্রত্যাশাকেই হাওয়া চ্যালেঞ্জ করেছে। হাওয়ার চরিত্রগুলো অত্যন্ত সাধারণ।বাস্তব জীবনে আমাদের উচ্চাভিলাষী নজরের বাইরে থাকে এই মানুষগুলো। অথচ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে এইসব মানুষের গল্প দেখতে হলো। আর তাই, আমরা কেউ কেউ এটাকে নাটক নাম দিয়ে দিলাম। মজার বিষয় হল, ঝাঁ চকচকে রোমান্স আর অ্যাকশনই যদি মুভির একমাত্র ক্রাইটেরিয়া হয় তাহলে তো পথের পাঁচালীও নাটক বলে গণ্য হবে এক সময়।

আর একটা বিষয় হল, একে তো চরিত্রগুলো সমাজের নিচুতলার, তার উপর আবার এই অভিনেতারা টিভিতেও অভিনয় করেন। টিভির শিল্পীদের তো ঘরে বসেই দেখতে পাই। এদেরকে আবার সিনেমা হলে গিয়ে দেখব! অতএব, অতি অবশ্যই এটা নাটক, এটা কোন ফিল্ম নয়। অথচ ফিল্ম ডেফিনেশন বলে, মুভিং ইমেজ হিসেবে ক্যামেরা দিয়ে ধারণকৃত যে কোন গল্পই হল ফিল্ম। আর সেই ডেফিনেশন অনুযায়ী টিভিতে প্রচারিত যে ফিল্মকে আমরা নাটক বলে থাকি, সেটাও আসলে ফিল্ম/মুভি। নাটক বা play বলতে মঞ্চের লাইভ পারফর্মেন্সকে বোঝাচ্ছে। কেন আমাদের দেশে টিভিতে প্রচারিত আধা ঘণ্টা/ একঘণ্টার টেলিফিল্ম কে আমরা নাটক বলতে শুরু করেছিলাম, সেটা আমি জানি না। শব্দবোদ্ধা, নাট্যবোদ্ধারা এর ব্যাখ্যা ভালভাবে দিতে পারবেন।

হাওয়া দেখতে গিয়ে শেষের দিকে আমার বারবার মনে হয়েছে, The Rime of the Ancient Mariner-এর আবহ তৈরি হয়েছে। অভিশপ্ত ঐ জাহাজে কি অদ্ভুত অনিশ্চয়তা! তবে মারিনারের জন্য আমাদের মায়া হয়। কিন্তু চান মাঝির জন্য হতে গিয়েও হয় না। নাগুর সাথে তার আচরণ দেখে তার প্রতি কিঞ্চিৎ করুণা হয়। কিন্তু পোষা শালিকটাকে মেরে খাওয়ার মধ্যে দিয়ে তার চরিত্রের নিষ্ঠুরতা আবার নতুন করে প্রকাশ পেল। একটা চরিত্র তাকে কয়েকবার ‘ডাকাইত চান’ বলে উল্লেখ করে। নিজের পোষা শালিকটাকে ঠাণ্ডা মাথায় পুড়িয়ে খেতে খেতে সে প্রমাণ করলো যে, সে একটি নিখাদ অমানুষ, সে আসলেই ডাকাইত চান।এই পাখির দৃশ্যটা এই মুভির অন্যতম শক্তিশালী দৃশ্য। অন্য যে কোন হত্যার চাইতে এই সামান্য পাখি হত্যা দিয়ে চান মাঝির চরিত্রের সবচেয়ে অমার্জনীয় এবং অসংবেদনশীল দিকটা প্রকাশ পায়। অন্য যে কোন হত্যাকাণ্ডের জন্য সে বলতে পারবে, তার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল, সে নিজেকে সামলাতে পারে নি। কিন্তু শুধু মাংস খেতে ইচ্ছে হয়েছে বলে নিজের একমাত্র প্রিয় পাখিটাকে সে ঠাণ্ডা মাথায় বারবিকিউ করে খেয়েছে। আর এই মুহূর্তে নাগুর এক্সপ্রেশনটাও অসাধারণ ছিল। চান মাঝির প্রতি বিতৃষ্ণা, তার নির্দয়তা দেখে স্তম্ভিত ভাব সব একসাথে ফুটে উঠেছিল নাগুর চোখে।

এই মুভির সিম্বলিজম, ফোরশ্যাডো করার টেকনিক অতুলনীয়। খুব অদ্ভুত একটা দৃশ্য ছিল সিনেমার গোড়ার দিকে। ফ্রেমে ছিলো শালিক পাখি আর চঞ্চলের মাথার উপরাংশ। চঞ্চলের চোখ ছিল পাখির দিকে। এই ফ্রেমটা আমার খুব অস্বস্তিকর মনে হচ্ছিল। এত চোখ জুড়ানো শট নেয়া পরিচালক এরকম একটা শট কেন নিলেন? চঞ্চলের মুখের পুরো অংশটা কি ফ্রেমে নেয়া যেতো না? কেন শুধু চোখ পর্যন্ত নিয়ে মুখের নিচের অংশ কেটে দেয়া হল? পরে যখন সে পাখিটা খেয়ে ফেলে, তখন এই দৃশ্যের ব্যঞ্জনাটা বোঝা যায়। মুভির একদম শুরুতে বাজারের উপর ক্যানভাসারের কণ্ঠস্বর পুরো বাজারের মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। সে বারবার বলতে থাকে, ‘বিশ্বাস উইঠা গেছে ভাইজান!’ গোটা প্রেক্ষাগৃহ তার গলার স্বরে গমগম করতে থাকে। আমরা পুরো মুভি জুড়ে ঐ কয়টা বাক্যের সত্যতা উপলব্ধি করতে থাকি।

চান মাঝি এবং তার অতি কাছের সাগরেদের মুখের উপর আলো ছায়ার খেলা খুব নিপুণভাবে ব্যাবহার করা হয়েছে। যখন এজা চান মাঝির সাথে চক্রান্ত করতে আসে, তখন বাইরের আলোটা পার হয়ে অন্ধকার কেবিনের মধ্যে ঢোকে। মুখের উপর আলো থেকে অন্ধকারে ছায়া পড়াটা অসাধারণ ছিল। এছাড়া পারকেসের হ্যালুসিনেশন, সাগরের অদ্ভুত সুন্দর নীলের উপরে আকাশের রঙের খেলা- সবটাতে পরিচালক অভূতপূর্ব দক্ষতার ছাপ রেখেছেন।

অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু না বললেও চলে। চঞ্চল চৌধুরী নামটাই যথেষ্ট। কিন্তু আনন্দের বিষয় হল, অন্য প্রতিটা অভিনেতাই পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন। মুভি শেষে প্রতিটা দর্শক বলেছে, এই মানুষগুলোকে দেখে মনে হয়েছে তারা আজীবন জেলের কাজই করে এসেছেন। যে মানুষটা গুলতিকে উপরে পানি নিয়ে যেতে বলে, তার ‘অপ্রে’ উচ্চারণটা পর্যন্ত কানে এখনো লেগে আছে। স্ক্রিনটাইম কম পান বা বেশি- সবাই নিজের সর্বোচ্চটা ঢেলে দিয়েছেন।

কিন্তু তবু একটা জিনিষ খুব চোখে লেগেছে। মাঝ-সমুদ্রে নায়িকার ঠোঁটে শাড়ির সাথে ম্যাচিং লিপস্টিক। গালে মেকআপ। ব্যাপারটা ভারি দৃষ্টিকটু ছিল। পরিচালক শরিফুল রাজকে, চঞ্চল চৌধুরীকে শতভাগ জেলের লুক দিতে পারলেন, আর নায়িকাকে সাগর থেকে বেঁচে ফেরা লুক দিতে পারলেন না? কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এটা কালাজাদু। অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতার বলে এটা সম্ভব হয়েছে। সেক্ষেত্রে, প্রশ্ন ওঠে- জাদুর সাহায্যে মেকআপ করা গেলে জাদু করে শাড়ি বদলানো গেলো না কেন? আর মেকআপটা যদি তার কালাজাদুই হবে, তাহলে অন্য কোন চরিত্র এটা নিয়ে একটাও মন্তব্য করলো না কেন? গানের উচ্চারণের আঞ্চলিকতাকে ধরে রাখা, নিখুঁত ফ্রেমিং বজায় রাখা পরিচালক এই কাজটা কেন করলেন তা বোঝা গেল না।

তবে, হাওয়া মুভিটাকে খুব হাস্যকর কিছু অভিযোগ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। যেমন, এখানে নাকি অকারণে গালাগালি ব্যবহার করা হয়েছে। আচ্ছা, মাছধরা বোট বাদ দিন। আমাদের গ্রামীণ জীবনের শ্রমজীবী মানুষদের দিকে একবার তাকান। এরা সারাক্ষণ চ-বর্গীয়, ঠ-বর্গীয় শব্দ ডালভাতের মত ব্যবহার করে। এই শব্দগুলো বলতে বলতে আপনাকে দেখতে পেলে, আপনার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করবে। আবার পরমুহূর্তেই ঐ ভয়ানক শব্দস্রোতে ডুব দেবে। তাই, ওদের গালাগালি দেখে যারা আশ্চর্য হচ্ছেন, তারা বোধহয় এ দেশে আদৌ বাস করেন না। আর এই সিনেমা অতি অবশ্যই বাচ্চা নিয়ে দেখা যাবে না। পৃথিবীর প্রতিটা শিল্প যে সপরিবারে উপভোগ করতেই হবে, তার তো কোন মানে নেই।

সব মিলিয়ে হাওয়া একটা অসাধারণ কাজ। বাংলা সিনেমা দিন দিন ক্যামেরার কাজে, অভিনয়ে, এডিটিংয়ে, মিউজিকে- সব দিক দিয়ে অন্যরকম উচ্চতায় পৌঁছে যাচ্ছে। ছক ভেঙ্গে গল্প তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন রুচির মানুষের জন্য মুভি হচ্ছে, এটা আশাব্যঞ্জক।

সবার সব কিছু ভালো লাগবে না। সেটাই স্বাভাবিক। কেউ অ্যাকশন দেখবে, কেউ রোমান্স দেখবে। কেউ বাস্তব ধর্মী গল্প দেখবে। সেগুলো নিয়ে দক্ষ হাতে সুস্থ বিনোদন হোক, এই প্রত্যাশা করি। দিনশেষে, আর্ট জয়যুক্ত হোক, আর্ট জয়যুক্ত হোক, আর্ট জয়যুক্ত হোক।

হাওয়া #সিনেমা #চঞ্চলচৌধুরী #শরীফুলরাজ #মেজবাউররহমানসুমন #বাংলাদেশ

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s