আমার কাছে কেউ লেখা চাইলে আমি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে যাই। আমার গোটা জীবনের লেখা গুনলে ৩/৪টার বেশি হবে না। যখন কেউ চেয়েই বসেন, তখন তার জন্য আমি আমার ঝোলা হাতড়াতে বসি। ঝোলার মধ্যে থাকা ৩/৪টা কুমিরের বাচ্চাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এর ওর হাতে তুলে দিই। এবার এক হিতৈষী লেখা চেয়ে বিপদে ফেলে দিলেন। কারণ কয়েক বার তাঁকে লেখা দিয়ে দিয়ে এবার আমার ঝোলা প্রায় খালি। হাতড়ে হাতড়ে একটা আধা খাওয়া কুমিরের বাচ্চা পাওয়া গেল। আমার পুরনো ব্লগে অর্ধেকটা আছে। তার নিচে লেখা ‘চলবে’। সর্বনাশ! এর বাকি অংশ কোথায় পাবো?
আমার পুরনো সেই কম্পিউটার মৃত। অর্থাৎ এ লেখা আর উদ্ধার করা যাবে না। তাঁর মানে হল, বাকি অংশ আমাকে আবার নতুন করে লিখতে হবে।
কিন্তু এটা তো প্রথম লেখা হয়েছিল ১৬ বছর বয়সে। লেখিকা তখন ইন্টারমিডিয়েট ১ম বর্ষের ছাত্রী। অত্যন্ত সিরিয়াস পাঠক। জীবন সম্পর্কে তার একটা সিরিয়াস দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সে বিশ্বাস করে যে পড়ে এবং লিখে দুনিয়া বদলে দেয়া যায়। নিজের মতাদর্শকে সে নির্ভুল মনে করে। প্রায় শুদ্ধতাবাদী চোখ দিয়ে দুনিয়াটা দেখে। লিখতে বসলে অতি খটোমটো সব শব্দ লিখে সে মনের বিরাট বিরাট ভাব প্রকাশ করে। মহাভারত, পার্থিব, আনা কারেনিনা, প্রথম আলো-র মতো একেকটা মোটা মোটা বই কয়েকদিনে পড়ে শেষ করে।
এই মহাপণ্ডিতের সাথে বর্তমানের ‘আমি’-র তো কোন মিল নেই! লেখার স্টাইল তো অনেক দূরের ব্যাপার,এর পাঠাভ্যাসের ধারেকাছেও তো আমি নেই। মোটা মোটা বই দেখলে এখন তো আমার গায়ে জ্বর আসে। এবার কী হবে!
কয়েকবার করে আগের লেখাটা পড়লাম। চোখের সামনে সেই পুরনো টেবিল, কুষ্টিয়ার বাড়ি, আর পুরনো সাদা মনিটরটা ভেসে উঠল। পড়তে গিয়ে এবার আর বিরক্ত লাগল না। সেই কিশোরী লেখিকাটির প্রতি একটা স্নেহ অনুভব করলাম। কত ইনোসেন্ট ছিলো মেয়েটা! এই বিপুলা পৃথিবীর কোথাও আর সেই মেয়েটির অস্তিত্ব নেই।
আমি চেষ্টা করলেও আর এরকম কোন লাইন লিখতে পারবো না। লাইনগুলো সুলিখিত নাকি কুলিখিত- সে বিচারে যাবো না। তবে, প্রতিটি লাইন গভীর আন্তরিকতার সাথে লেখা। পরম বিশ্বাসের সাথে লেখা। ঐ সরল বিশ্বাস আর প্রকাশভঙ্গির সিরিয়াসনেসকে নকল করা সহজ হবে না। উচিতও হবে না। ওটুকু আগের মতোই থাক। বাকিটুকু আমি আমার এখনকার মতন করেই লিখি। তরলমতি শ্যামা যেমন লেখে।
যদি টাইম মেশিন বলে কিছু থাকত, তাহলে আমি ঐ শ্যামার কাছে একবার ফিরে যেতাম। ওকে বলতাম,জীবনটাকে এত সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই। কারোর কোন ক্ষতি না করে আনন্দের সাথে বাঁচো। তাতেই তৃপ্তি। কারোর কাছে ইমেজ ধরে রাখার ফাঁদে পড়েছ কি মরেছ। তাকে বলতাম, রবীন্দ্রনাথের ঐ গানটা শুনতে- ‘তোমার পরে নেই ভুবনের ভার, ওরে ভীরু।‘ হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার।’ ও কি তখন বুঝত গানটার মানে? কী জানি!
তবে যাই হোক, দু রকম স্টাইলের চক্করে পড়ে লেখাটা বর্তমানে নিচের ঐ ঘোড়াটার আকৃতি পেয়েছে। যাঁরা বুঝবেন, তাঁরা জানবেন।
