ক্লাস এইটের স্কলারশিপ পরীক্ষা। স্কলারশিপ পরীক্ষার জন্য সিলেক্টেড হওয়াটাও আমাদের মত ব্যাকবেঞ্চারের কাছে একটা সেইরকম খবর ছিল। বাংলাদেশ কখনো বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য চান্স পেলে যেমন অবস্থা হবে আমাদেরও ঠিক তেমন অবস্থা ছিল। স্কলারশিপ জেতার কোনরকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। রিল্যাক্সমুডে বসে বসে এক ঝাঁক ব্রিলিয়ান্টদের দিকে চেয়ে দেখছিলাম। আমরা দুই বন্ধু প্রায় পরপর বেঞ্চিতে বসেছি। মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে বসে আছে এক অতিমাত্রায় ভাল ছাত্রী। সেই সিরিয়াস ছাত্রীটি তার মনগড়া কোন কারণে আমাকে লেখাপড়ায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করত (তার আর আমার সিরিয়াল খুব কাছাকাছি থাকত বলেই হয়ত।)। অথচ তার এতটা মনোযোগের যোগ্য আমি ছিলাম না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অদ্ভূত কোন খেয়ালে আমার চেহারাটা দেখে গোড়ার দিকেই কেউ কেউ আমাকে ভাল ছাত্রী বলে ধরে নেন। যাহোক, সেই মহামান্যা এক্সাম হলে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন- নিজে যদি স্কলারশিপ নাও পান তবু আমারটা যে করেই হোক আটকে দেবেন। সেদিন অঙ্ক পরীক্ষা। অঙ্কে আমার সাংঘাতিক ভীতি। যে কয়টা পারি করে চুপচাপ বসে থাকলাম। এদিকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের তো মন মানেনা। ও অঙ্কে ভীষণ ভাল। ও চাইছে এই শেষ পনের মিনিটে আমাকে হেল্প করতে। কিন্তু ঠিক যে অঙ্কটা আমার করা বাকি আছে, সেটা ও করে নি। ও সামনের সেই ব্রিলিয়ান্টকে কাকুতি মিনতি করতে লাগল- প্লীজ, আমাকে কিচ্ছু দেখাতে হবে না। আমি তোমাকে একটা বলে দেব। তার বদলে শ্যামাকে ওই অঙ্কের সূত্রটা একটু বলে দাও। আমি জানি, তুমি ওই অঙ্কটা করেছ।“ আমার বেঞ্চ থেকে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। মজার কথা হল, পরীক্ষার হলে দেখাদেখির প্রতিভা আমার শুন্য। মেয়েটি দেখাতে চাইলেও আমি দেখে উঠতে পারতাম না। মেয়েটি হাসিমুখে খাতা ঢেকে বসে থাকল। আমার বন্ধুটা অসহায় মুখে দুই বেঞ্চ দুরত্ব থেকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকল। পরীক্ষা শেষে বরাারের মতই দাঁত বের করতে করতে বের হয়ে এলাম। কিন্তু আমার বান্ধবীর চোখ জলে টলমল করছে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে জল আটকে রাখার। আমি ওই অঙ্কটা করতে পারি নি-এই দু:খ ও ভুলতে পারছে না। ওকে সেদিন কিছু বলি নি। মনে মনে ভাবলাম, “যদি ওই মেয়ের কাছে দেখতাম, সেটা হত আমার সারাজীবানের কলঙ্ক। আর ও দেখায় নি বলেই আমি তোকে চিনলাম। জানতে পারলাম, বন্ধুত্ব এত নি:স্বার্থ হতে পারে। ওই অসীম শত্রুভাবাপন্ন মেয়েটির কাছে আমি কৃতজ্ঞ।“
বলা বাহুল্য স্কলারশীপ পাই নি। কিন্তু তার বদলে গোটা স্কুলজীবনে যা পেয়েছি, তার তুলনা নেই। আমরা পাঁচ বাঁদর নিজেদের নাম দিয়েছিলাম-পঞ্চ পান্ডব। বিজ্ঞান ভবনের ছোট দুই সীটের ডেস্ক সেট- আপ আমাদের মনে ধরে নি। সমস্ত গার্ড আর বুজিদের নজর এড়িয়ে কলা ভবন থেকে পাঁচ জন বসার মত বেঞ্চি টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম বিজ্ঞান ভবনের দুই তলায়। বসব যখন, পাঁচজনই একসাথে বসব। কেউ এক টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়ে যা কিছু নোট, সাজেশন্স পেত- সব কিছু নিজ দায়িত্বে সে-ই পাঁচ কপি করে ফেলত। নোট নিয়ে অতি কাছের বন্ধুদের মধ্যেও অনেক কূটনামি দেখেছি। আমাদের মধ্যে সেটা ছিল না।
আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যাকে পেলাম তার মাথার সাথে আমার ওয়াইফাই কানেকশন ছিল। কোনকিছু মুখে বলা লাগত না। এমনিই বুঝে যেতাম। দুই বন্ধু সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে বসে বসে উল্টোপাল্টা গল্প করে যাচ্ছি। দুপুর সাড়ে বারটার বাসটা ধরার কথা। ১২.২৫ এর সময় দুজন একসাথে বলে উঠতাম। “ধুর, এখন এখান থেকে মলচত্বরে পৌছানো যাবে না। ১.২০ এর বাসে যাব।” মজার ব্যাপার হল, ১.১৫ বাজলেও এই একই রিয়ালাইজেশন হত। এরকম করতে করতে প্রথম দুই বছরে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি ফিরতাম ক্ষণিকার লাস্ট বাসটা ধরে। বন্ধুত্ব বোধহয় এমনই। ছোটবেলায় পড়ে আসা ‘সময়ের মূল্য” রচনাকে নিমেষে ভুলিয়ে দিতে পারে।
কোন কোন বছর, পঞ্চপান্ডবের কারো জন্মদিনে আমি যখন খুব ভাব নিয়ে ফোন করে “’হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ গানটা গেয়ে উইশ করি, তখন ওপাশ থেকে সে বলে ওঠে, “ ফালতু ভাব মারিস না। তা, এ বছর কে মনে করিয়ে দিল, ববি, তাশা, নাকি মৌলি?” আমার কোন খোঁড়া যুক্তি তখন কাজে আসে না। বন্ধুত্ব বোধহয় এমনই। ভুলোমনা বন্ধুর স্টুপিডিটি মেনে নিয়ে, তার উপর হম্বি-তম্বি করে আবার তাকে কাছে টেনে নেওয়া।
চাকরিজীবনে এসে যাদেরকে পেয়েছি, তারা আমার মত একটি টিউবলাইটকে কেন এবং কী কারণে এত সহ্য করে আমি জানি না। আমার প্রতিটি দুর্বলতা মেনে নিয়ে নিজের ঘাড়ে এক্সট্রা চাপ নিয়ে এরা কী আনন্দ পায় আমি বুঝি না। তাদের কেউ কেউ আবার দেশ কাল সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে বারবার মনে করিয়ে দেয়, “তুমি আমাকে সহ্য করতে না পারলেও কিছু করার নেই। যেখানেই থাকি, আমি তোমার জীবন থেকে সরছি না।” কেউ আবার মনে করিয়ে দেয়, ‘তোর ভালবাসাব ধার ধারি না। আমার কাজ আমি করে যাব।” কেউ আবার অসীম নির্ভরতার দৃষ্টিতে চেয়ে আমার মত অভাজনকেও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
আমার জীবনের বেস্টফ্রেন্ডদের একজনকেও আমি সিলেক্ট করি নি। নিজে আগ বাড়িয়ে কারো সাথে বন্ধুত্ব করার প্রতিভা আমার নেই বললেই চলে। তবু এরা আমার বন্ধু হয়ে আছেন। মেনে নিতেই হয়, এরা ঈশ্বরের মনোনীত। আমার বন্ধুদের মত ধৈর্যশীল জীব খুব কমই হয়। আমার মত একগুঁয়ে, বদমেজাজী, অালসে, অমিশুকে, ভুলোমনা, অসামাজিক, ঘরকুনো প্রজাতির প্রাণীকে যারা দিনের পর দিন সহ্য করে চলেছেন, তারা নি:সন্দেহে ঈশ্বরের বিশেষ সৃষ্টি। আমার চোখে তারা ছোটখাট মহামনীষী।
(বন্ধু দিবস ২০১৫ উপলক্ষে লেখা)
(আগস্ট ২, ২০১৫)
বন্ধু হলো ক্ষণিকের ভালো লাগা। মুহূর্তের জন্যে দু চোখ বিনিময়।
LikeLike