অ(তি)সাধারণ

বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলার চাইতেও বড় সমস্যা আমার সামনে-  To have coffee or not to have coffee ।

যার অফিসে এসেছি তিনি আমাদের জন্য কফি অর্ডার করছেন। পিয়নের হাতে টাকা দিলেন। আমরা দিনের শুরুর দিকে এসেছি। তাই, কফির অর্ডার করা সহজ হল।

কোন কোন অফিসে চা অতি দুর্মূল্য বস্তু। একই ফ্লোরে অনেকগুলো কর্মকর্তা একসাথে কাজ করেন যখন, তখন তারা ইচ্ছে থাকলেও অতিথিকে সুবিধামত চা খাওয়াতে পারেন না। কর্মকর্তা এবং অতিথির তুলনায় পিয়নের সংখ্যা কম বলেই হয়তো।  

যে ভদ্রমহিলার কাছে আমরা এসেছি, তিনি ভারি চমৎকার করে কথা বলেন। উচ্চারণ স্পষ্ট, গলার স্বর মিষ্টি, আচরণ অত্যন্ত মার্জিত। রুচিশীল ব্যক্তিত্বের একটা কমপ্লিট প্যাকেজ। অনুরোধে ঢেঁকি গেলা যায়, আর এত মার্জিত মানুষের কথায় তো আস্ত একটা পর্বতও গিলে ফেলা যায়। অথচ আমি এক কাপ কফি গিলতে পারছি না।

অর্ডার করার সময় আপত্তি করতে পারি নি -দ্বিধায়। এনার কাছে আমরা একটা  সমস্যা নিয়ে এসেছি। প্রথমেই যদি ইম্প্রেশন খারাপ করে ফেলি, তাহলে কাজটা না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অতএব, বলা যাবে না যে, আমি কফি খাই না।

আলাপ-আলোচনা শুরু হল। ভদ্রমহিলার জানা-শোনার পরিধি অনেক। একটা পর্যায়ে আমার মনে হল, উনি আমার দিকে বেশ খানিকটা মনোযোগী হয়েছেন। হয়তো আমাকে তাঁর ভালো লেগেছে। আমার দেশের বাড়ির কথা শুনে আরো একটু খুশি হলেন। তাঁর সাথে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তুও বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল।

আমার পাশের দুজনের মধ্যে কোন হেলদোল নেই। আমার দুই সঙ্গী কিন্তু জানে যে আমি কফি খাই না, কেন খাই না তাও জানে। তবু এদের মুখে টেনশনের কোন ছাপ নেই।

পিয়ন এবার নাস্তা নিয়ে হাজির হয়ে গেল। তিন কাপ কফি, দু প্যাকেট বিস্কুট, ক্ষীরখেজুর, আম দিয়ে টেবিল সাজিয়ে ফেলল। ভদ্রমহিলা নিজে হাতে খেজুরগুলো ধুলেন। খুব আন্তরিক স্বরে আমাদেরকে খেতে বললেন। আমরা ততক্ষণে আমাদের কাজের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কথা বলছি। তার কিছু চ্যালেঞ্জের সাথে আমার অভিজ্ঞতা মিলে গেল। আমার সঙ্গী এক বন্ধু উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় আমাকে ভাসাতে লাগলেন। ভদ্রমহিলা তার সাথে একমত পোষণ করলেন।

আমিও তার প্রতি আমার ভালো লাগার কথা জানালাম। তার ব্যক্তিত্ব আর সুনামের মধ্যে যথেষ্ট সঙ্গতি আছে- তাকে সেটা জানলাম। এটা মন থেকেই জানালাম। উনি আসলেই সুনামের যোগ্য।

আমার সঙ্গী দুজন ভাবলেশহীন মুখে ততক্ষণে কফি খেতে শুরু করে দিয়েছে। আমি আমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কফিটা ক্রমেই ঠান্ডা হচ্ছে। ভদ্রমহিলা যদি জিজ্ঞেস করেন কফির কথা? আমরা চলে যাবার পরে পিয়ন এসে টেবিল সাফ করার সময় নিশ্চয়ই বলবে- একটা কফি কে জানি না খাইয়া ফালাইয়া গেছে! হোস্ট হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই বিরক্ত হবেন এ কথা শুনে।

কি তুচ্ছ একটা সমস্যা! কিন্ত আমার মত একটা কল্পনাপ্রবণ বেকুবের জন্য কি বিরাট একটা সমস্যা!

হঠাৎ এক ভদ্রলোক এলেন।  তাকে দেখে বোঝা গেল, তিনি বেশ সিনিয়র। একটা কম্পিউটার টেবিলের চেয়ার ছাড়া আর কোন চেয়ার ফাঁকা নেই। আমার মনে হতে লাগল, আমরা খুব বেশি সময় ধরে এখানে বসে আছি। আমাদের ওঠা উচিত। কিন্ত আমার দুই সঙ্গী মারাত্মক কমফোর্টেবল চোখ-মুখ করে বসে আছে। ওদের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আমিও বসে থাকলাম।

মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল। দিনের এই মধ্যভাগে এই লোকের জন্য নতুন করে কফি হয়তো আসবে না। অতএব, কফিটা একে সাধলে কেমন হয়? কিন্তু নিজে অতিথি হয়ে এনাকে কফি সাধলে সেটা বেয়াদবি হয়ে যেতে পারে। পাশের জনকে অনুচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলাম। সে সন্তের মত মুখ করে বলল, বলে দেখো কী হয়।

আল্লাহর নাম করে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “কফি খাবেন?” উনি খানিকটা গাম্ভীর্য এবং খানিকটা অনুগ্রহ মিশিয়ে জানালেন, “খাওয়া যেতে পারে।” আমি কৃতার্থমুখে কফিটা তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে দেখলাম, সমান তালে আরো একটা হাত নতুন একটা কাপ রেডি করছে। ভদ্রমহিলা আমার জন্য তার নিজের ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দিলেন আর একটা কাপে। বললেন, “এটা আমার চা। প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বানিয়ে আনি। খেয়ে দেখো। কেমন লাগে।”

অদ্ভূত রিল্যাক্সড লাগল। মনে হল, বহুদিন পরে আমি আমার সেই ইনফর্মাল, ভাবনাহীন কাজের জগতের সহকর্মীদের সঙ্গে বসে আছি- যাদের সাথে আমি নির্ভাবনায় নিখাদ আন্তরিকতার সাথে মিশতে পারতাম।

একটু আগে ঠিক যতটা আড়ষ্ট ছিলাম, এখন ঠিক ততটাই সহজ হলাম। পুরোটাই ভদ্রমহিলার স্মার্টনেস আর কাইন্ডনেসের কারণে, বলাই বাহুল্য। জাজমেন্টাল মানুষ দেখতে দেখতে আমি ইদানীং অত্যন্ত নার্ভাস এক ওভারথিংকারে পরিণত হয়েছি। এই ঘরটাতে কিছুক্ষণের জন্য আমার অতীতের ফর্ম ফিরে পেয়ে ভালো লাগল।

আমার সঙ্গী বন্ধু পরে আমাকে জানিয়েছিল, সেও নাকি ভয়ে ছিল। কফির নাম শুনে আমি দৃশ্যতই প্যানিক করে ফেলব এই ভেবে তার খুব টেনশন হচ্ছিল। এবং আমার প্রতি ভদ্রমহিলার রেসপন্স দেখে আমার বন্ধুও অত্যন্ত ইম্প্রেস্ড।

কোন এক অ(তি)সাধারণ দিনের এক অসাধারণ আন্তরিকতার স্মৃতি অনেক দিন রয়ে যাবে আমাদের মনের মধ্যে।

2 comments

Leave a comment